ঢাকা | বৃহস্পতিবার | ২৪শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

জয়পুরহাটের বাইগুনি: কিডনি বিক্রির কলঙ্কিত গ্রাম

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে প্রবল দারিদ্র্যের কারণে বিক্রি হচ্ছে মানুষের জীবন ও অঙ্গ—এই গ্রামকে তাই ‘এক কিডনির গ্রাম’ও বলা হয়। ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিনের জীবনের গল্প এদেশের অসংখ্য মানুষের কথা বলেছে। ২০২৪ সালে তিন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের একটি কিডনি বিক্রি করে তিনি ভারতের একটি ব্যক্তিকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পান। তবে ওই অর্থ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর ভাঙা বাড়ির নির্মাণ থেমে যায়, আর শরীরের ব্যথা তাকে বারবার সেই কঠিন সিদ্ধান্তের মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়।

সফিরুদ্দিন এখন হিমাগারে দিনমজুরের কাজ দিয়ে সংসার চালান। দুর্বল শরীরের মাঝে প্রতিদিনের কাজ করা তাঁর জন্য কঠিন, তবুও তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য সবই করেছি।’ দালালদের ফাঁদে পড়ে ভারতে ট্রানজিটের সময় নিজের পাসপোর্ট থাকলেও হাসপাতালে তাঁকে রোগীর আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়, এমনকি ভুয়া আইডি কার্ড ও জন্মসনদও তৈরি করা হয়। সফিরুদ্দিন জানেন না তিনি যাকে কিডনি দিয়েছেন, তিনি কে।

ভারতের আইন অনুযায়ী কিডনি দানের ক্ষেত্রে কেবল নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈধতা রয়েছে, অন্যথায় সরকারি অনুমোদন আবশ্যক। কিন্তু দালালরা ভুয়া নথি তৈরি করে আইনকে পাশ কাটিয়ে কাজ চালিয়ে যান। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মনির মোনিরুজ্জামান জানান, প্রতারণার পদ্ধতিগুলো প্রায় একই রকম থাকলেও ভুয়া নথি, নামে পরিবর্তন ও জাল পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়।

বাইগুনি গ্রামের প্রায় ছয় হাজার মানুষ মধ্যে প্রতি ৩৫ জনের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন বলে ২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশই দারিদ্র্যের কারণে বাধ্য হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেন, কেউ ঋণের বোঝা মোকাবিলা কিংবা মাদকাসক্তি ও জুয়ার অভিশাপে জড়িত থাকেন।

দালালরা অপারেশনের পর কাগজপত্র, ওষুধ বা চিকিৎসা সেবা প্রদান না করে বিক্রেতাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে যান। সরাসরি চিকিৎসার অভাবে শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়। এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এটি শুধু ব্যক্তির জীবনের ক্ষতি নয়, একটি বৃহৎ অবৈধ চক্রের ফলাফল।

ভারতের ধনী রোগীরা সরাসরি বৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষা এড়িয়ে এই অবৈধ বাজার থেকে কিডনি কিনছেন। ২০২৩ সালে ভারতে মাত্র ১৩,৬০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হলেও প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষের অতি শেষ পর্যায়ের কিডনির সমস্যা রয়েছে। আইনি ব্যবস্থা থাকলেও দালাল-হাসপাতাল-চিকিৎসকসহ যাঁরা লাভের জন্য এ ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগের অভাব তীব্র ব্যথাদায়ক।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রেতারা তাদের পয়সাও পুরোপুরি পাচ্ছেন না। যারা দালাল হয়ে উঠেছেন, তাঁরা নতুন বিক্রেতা খুঁজে বের করে অবৈধ চক্র চলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৯ সালের পরে ভারত সরকার কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সুফল আসেনি। ঢাকা ও ভারতের হাসপাতালগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এমন অবৈধ বহর অব্যাহত রয়েছে।

বাইগুনি গ্রামের সফিরুদ্দিনের মতো মানুষ প্রতিদিন নিজেকে ফুঁসে উঠা ক্ষত আর পরিবারের দায়ভার নিয়ে জীবনের কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। তাঁর ভাষায়, ‘তারা কিডনি নিলো আর আমাকে ফেলে চলে গেল।’

অঙ্গদানের বৈধ ও মানবিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা আজ আরও বেশি জরুরি, যেখানে কিডনি বিক্রেতাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তাহলেই হয়তো ‘এক কিডনির গ্রাম’ থেকে রেহাই মিলবে মানবিকতার জয়গান।