দেশের জলজ জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ হয়ে উঠেছে নিষিদ্ধ ‘চায়না দুয়ারী’ জাল। একবার এই জালে মাছ বা অন্য জলজ প্রাণী আটকা পড়লে তা মুক্তি পায় না। মৎস্য অধিদপ্তর নিষিদ্ধ করার পরও পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা, বি-নগর ও পুঙ্গলী ইউনিয়নে এই জালের অবৈধ উৎপাদন থামছে না।
সর্বক্ষণ প্রশাসনের চোখের সামনে, ঘরের গেট বন্ধ করে নির্বিঘ্নে এই জালের উৎপাদন চলে আসছে। প্রচুর চাহিদার কারণে স্থানীয় কারিগররা তৈরি ফ্রেম ও জাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠাচ্ছেন।
ডেমরা ইউনিয়নের একাধিক কারখানা মালিক ‘‘কারখানা মালিক সমিতি’’ গঠন করেছেন, যার ছায়ায় ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুয়েল রানা। স্থানীয়রা বলেন, চেয়ারম্যানের নির্দিষ্ট সহায়তায় এসব কারখানা নির্বিঘ্নে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মালিকদের মধ্যে আছেন নিত্য হাওলাদার, দীপ্ত হাওলাদার, শ্যামল, বিপ্লব, সুশান্ত হাওলাদার, পশু চিকিৎসক পরিতোষ হাওলাদার এবং মাজাট সুইচগেট এলাকার আল-আমিন।
পুঙ্গলীর নারানপুর পশ্চিমপাড়া ও রতনপুর উত্তরপাড়া অঞ্চলের কালাম, রুহুল আমিন, মালেক, খোয়ালিদ, শাহিন, মোমিনসহ অনেকেই অবৈধ এই জাল তৈরির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়রা দাবি করেন, চেয়ারম্যান জুয়েল রানা ‘‘জুয়েল ফাউন্ডেশন’’ নামে একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান চালিয়ে এ ব্যবসায় জড়িত আছেন। সরকারি কোনো রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স ছাড়াই তারা নানারকম কাজে লিপ্ত। মাঝে মাঝে সরকারি চাল বিতরণ করলেও সেটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ বলেই অভিযোগ রয়েছে।
এই কারখানাগুলোতে অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর কাজ করা স্থানীয়দের আরও উদ্বেগের বিষয়। তারা স্কুলে না গিয়ে রাতের সময় জাল তৈরি করায় শিক্ষা হার কমে যাচ্ছে, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও নৈতিক সমস্যা বাড়ছে।
রাতের সময়ে জাল তৈরির সুযোগে মাদকবিক্রেতারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। রতনপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিলের দাপট বেড়ে গেছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চায়না দুয়ারী জালে মাছের ডিম ও ছোট মাছও ধরার ফলে দেশীয় মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ৫০ থেকে ১০০ ফুট লম্বা এবং দেড় ফুট প্রস্থের এই জালের ফাঁস এত ছোট যে, কোনো মাছই বাঁচতে পারে না।
স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘যখন নিষিদ্ধ জাল ধ্বংস করা হয়, তখনও এই কারখানাগুলো কেন বন্ধ হয় না?’’ ঈদের আগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ একাধিক অভিযান চালিয়েও কিছু পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে আসেনি।
ডেমরা ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল রানা বলেন, ‘‘আমার নিজস্ব কোনো কারখানা নেই, ছোট ভাইয়ের ব্যবসা ছিল, পরে বন্ধ করে দিয়েছি। একবার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কিছু জাল নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, পরে সেখান থেকেই টাকায় জাল কিনে এনেছিলাম।’’ তিনি আরও দাবি করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও সব জাল পুড়িয়ে ফেলা হয় না, কিছু জাল বিক্রি হয়। ‘‘আমি নিজেই এসব জাল কিনেছি, প্রমাণও রয়েছে।’’ তিনি অভিযোগ করেছেন, ঈদের আগে তাকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে মাসিক টাকা দিতে বলেও ব্যবসা চালানোর সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা তিনি গ্রহণ করেননি।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ জানান, ‘‘সম্প্রতি ডেমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেই সময় চেয়ারম্যান বাড়িতে ছিলেন না, থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’’ তিনি জানান, কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জব্দ করা সম্ভব হয়নি কারণ সেটি বহন করার জন্য সরকারি বরাদ্দ নেই।
অভিযান সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার অফিস থেকে যদি কেউ টাকা চেয়ে থাকেন, তা সরাসরি জানান। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সংশ্নিষ্টদের সম্মান রক্ষায়।’’ অভিযান চলাকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ফোন না দিয়ে পেশকারকে ফোন দিয়ে বলেন অভিযান আটকাতে, যাতে তার সম্মান রক্ষা পায়। কর্মকর্তারা অভিযানে ছবি তোলার অনুমতি না দিয়ে নিরবে ফিরে এসেছেন।
পাবনায় নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জালের ব্যবসা এখন কেবল একটি অবৈধ উদ্যোগ নয়, এটি একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের কিছু অসাধু সদস্যের সাহায্যে এটি পিছু ছাড়ছে না। এখন সময় এসেছে সরকারি কর্তৃপক্ষকে সত্যিকার পদক্ষেপ নিতে, নয়তো লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে এই অবৈধ ব্যবসার অব্যহতি চলতেই থাকবে।