ঢাকা | মঙ্গলবার | ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে লাঙল-জোয়ালের প্রাচীন ঐতিহ্য

গ্রামের মাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে অনবরত ছড়ানো বিস্তীর্ণ মাঠের নৈসর্গিক দৃশ্য, যা এখন আধুনিক কৃষি যন্ত্রের ছোঁয়ায় বদলে গেছে। কিন্তু সেই পরিচিত দৃশ্য যেন হারিয়ে গেছে যেখানে গরুর জোয়ালে বাঁধা, লাঙল টেনে চলা কৃষকের ঘামের গন্ধ উঠে আসত মাটির মধ্যে। এক সময় বাংলার গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লাঙল-জোয়ালের ব্যবহার, যা আজ শুধু স্মৃতির পাতায় বিদ্যমান। বাংলার কৃষিকাজ বলতে তখন বোঝানো হত লাঙল ও জোয়ালের যুগল প্রয়োগ। কৃষক যখন লাঙলের হাতল ধরা এবং গরুর ঘাড়ে জোয়াল বেঁধে জমির কোণে কোণে কাঁদামাটির গন্ধে মিশে যেতেন, তখন সেটাই ছিল গ্রামের অর্থনীতির প্রাণ।

কৃষকদের বিশ্বাস ছিল, লাঙল দিয়ে জমি চাষ করলে তা উর্বর হয় এবং প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে ওঠে। কিন্তু এখন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্র এসে এই ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়েছে। এগুলো ব্যবহার সহজ, সময় ও শ্রমের ক্ষেত্রে কম খরচ সাপেক্ষ হওয়ায় কৃষকরা ধীরে ধীরে চলমান ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যান্ত্রিক চাষাবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।

তবে এই আধুনিক পদ্ধতির আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে শুধু লাঙল-জোয়াল নয়, কৃষকের মাটির সঙ্গে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্কটিও। আজও কিছু প্রবীণ চাষি লাঙল-জোয়ালের দিনগুলোকে স্মরণ করে বলেন, “গরুর জোয়ালের শব্দে যেন মাঠে প্রাণ ফিরে আসত, লাঙলের ফলা মাটি কাটত, আর মনে হতো জমির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সেতুবন্ধন গড়ে উঠছে।” এই স্মৃতি শুধু এক প্রজন্মের নয়, বরং পুরো বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি গল্প।

জান্ত্রিক পদ্ধতির সুবিধা থাকলেও এর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, গরুর সংখ্যা কমে যাওয়ায় গোবর সার তৈরির প্রবণতাও বিলুপ্তির পথে। আসলে লাঙল-জোয়াল শুধু একটি প্রযুক্তি ছিল না; এটি প্রকৃতি ও মানুষের সুসমন্বয়ের বহিঃপ্রকাশ। এই পরিবর্তন কেবল কৃষিপদ্ধতির নয়, একটি সমগ্র সংস্কৃতির ধ্বংস।

এই ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন করা কঠিন হলেও আমাদের প্রজন্মের কর্তব্য এটি স্মরণে ধারণ করা। হয়তো একদিন কেউ আবার সেই প্রাচীন পদ্ধতির দিকে ফিরে তাকাবেন, এবং বাংলার মাটির গন্ধে ভরে উঠবে নতুন করে। লাঙল-জোয়ালের অস্তিত্ব স্মৃতির কোণে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে, আর এই ঐতিহ্যের গল্প কখনো হারাবে না।