ইলন মাস্কের কোম্পানিগুলোকে ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিলিয়ন ডলারের সরকারি ভর্তুকি বন্ধ করার হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার এই হুমকি জানানো হয়, যা একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাঝে চলমান দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তোলে।
বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ট্রাম্পের ‘‘বিগ বিউটিফুল বিল’’ নামক ট্যাক্স-কাট ও ব্যয় সংকোচন প্রস্তাব, যা সিনেটে পাস হয়ে গেছে। এই বিলের ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য বরাদ্দ সরকারি ভর্তুকি ও কর ছাড় বাতিল হওয়ার আশঙ্কা আছে, যা দীর্ঘদিন ধরেই টেসলা কোম্পানি পাচ্ছিল। মাস্ক এই বিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন, যা সেখান থেকেই দুই পুরনো মিত্রের মধ্যে অশান্তির সূত্রপাত।
সাম্প্রতিক অতীতে ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আতিথ্য গ্রহণে অংশ নিয়েছিলেন ইলন মাস্কসহ বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিরা। সেখানে একটি ডাইনিং টেবিলে বসে তারা রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যক্তিগত জীবন সংক্রান্ত বিস্তৃত আলোচনা করেন। তখন মাস্ক ট্রাম্পের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন ছিলেন এবং বিশেষ টাস্কফোর্স ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ বা ডিওজিই’র নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, যা সরকারি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল।
কিন্তু বন্ধুত্বের সেই সময় খুব বেশি দীর্ঘমেয়াদী হয়নি। হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়, যা এখন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। রাজনীতি ছাড়াও এই দ্বন্দ্ব এখন ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বাকবিতণ্ডায় রূপ নিচ্ছে। দুই পক্ষই সয়ে বসছেন না, আর এই পরিস্থিতিতে মাস্কের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক পরিকল্পনা উভয়ই ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
গত সোমবার মাস্ক আবারও ট্রাম্পের বিলের বিরুদ্ধে সরব হন। হোয়াইট হাউসের সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘‘ও (মাস্ক) তার বৈদ্যুতিক গাড়ির ম্যান্ডেট হারানোর কারণে ক্ষুব্ধ, তবে ও আরো অনেক কিছু হেরে যেতে পারে।’’
যদিও মাস্ক অতীতে সরকারি ভর্তুকি কমানোর পক্ষে ছিলেন, তার কোম্পানি টেসলা দীর্ঘদিন ধরে এসব সুবিধা ভোগ করে আসছে। ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য ৭ হাজার ৫০০ ডলারের ট্যাক্স ক্রেডিটসহ নানা সুবিধার কারণে গ্রাহকরা বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এগুলো কঠোর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। টেসলার শেয়ার মূল্যে মঙ্গলবার ৫ শতাংশেরও বেশি পতন ঘটে।
ইলন মাস্ক হুমকি দিয়েছেন, তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন এবং ট্যাক্স বিল সমর্থনকারী আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে প্রচার করতে অর্থ ব্যয় করবেন। যদিও তিনি সরকারি ব্যয় কমানোর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট মাস্কের সরকারের বাজেট সমালোচনার জবাবে বলেছেন, ‘‘দেশের অর্থনীতির তত্ত্বাবধান করা আমার দায়িত্ব।’’
মাস্কের নেতৃত্বে গঠিত ‘ডিওজিই’ প্রকল্প থেকেও মে মাসে সরিয়ে নেওয়া হয় তাকে। সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘‘ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি পেয়েছে মাস্ক। রকেট লঞ্চ, স্যাটেলাইট, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করলে আমেরিকার অনেক টাকাই বাঁচবে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ডিওজিই এমন একটি প্রক্রিয়া, যা শেষ পর্যন্ত ইলনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’’
জবাবে মাস্ক তার প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ লিখেছেন, ‘‘আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, সব ভর্তুকি এখনই বন্ধ করুন।’’ তিনি আরও জানান, তিনি প্রয়োজন হলে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতেন, তবে আপাতত বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এই দ্বন্দ্ব মাস্কের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিশেষ করে টেসলা বর্তমানে টেক্সাসের অস্টিনে একটি পরীক্ষামূলক রোবোট্যাক্সি প্রোগ্রামে বৃহৎ বিনিয়োগ করেছে, যার ভবিষ্যৎ সরকারি নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল।
বিশ্লেষক জিন মানস্টার বলেন, ‘‘টেসলার বাজারমূল্যের বড় অংশ স্বয়ংচালিত প্রযুক্তির অগ্রগতির ওপর নির্ভর করছে। যদিও তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না, তবে ঝুঁকি থাকবেই।’’
বুধবার টেসলা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের বিক্রয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইউরোপে বিক্রয় কিছুটা মিশ্র হলেও মাস্কের ডানপন্থী মতামত অনেক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ইভি ক্রেডিট বাতিল হলে টেসলার আয়ের ১.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হ্রাস হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ সালের মোট পরিচালন আয়ের প্রায় ১৭ শতাংশ। ইলেকট্রিফিকেশন কোয়ালিশন একটি ইভি সমর্থক সংগঠন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসকে সিনেট বিল সংশোধনের অনুরোধ জানিয়েছে।
টেসলার বিনিয়োগকারী গ্যারি ব্ল্যাক জানান, গাড়ির বিক্রি কমার কারণে তিনি শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং ইভি ক্রেডিট বাতিল হলে কোম্পানির ক্ষতি হবে। অন্যদিকে, স্পেসএক্স এখনও প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের সরকারি চুক্তির ওপর নির্ভরশীল। টেসলা বিভিন্ন নিয়ম মানার মাধ্যমে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার রেগুলেটরি ক্রেডিট বিক্রি করে আসছে, যার কারণে এপ্রিল মাসে তারা লোকসান থেকে বেঁচেছিল।
জুনের শুরুতেই ট্রাম্প মাস্কের সরকারি চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছিলেন, এবং এর পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে তাদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প এক সাংবাদিকের প্রশ্নে বলেছেন, ‘‘আমি জানি না মাস্ককে বিদেশে পাঠানো হবে কি না, সেটা যাচাই-বাছাই করা হবে।’’