গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে গেলে চোখে পড়ে বিস্তৃত কৃষিজমি, যেখানে আধুনিক যন্ত্রের ছোঁয়ায় চলছে চাষাবাদ। তবে, সেই জমিতে একসময় যা ছিল তার পরিবর্তন চোখে পড়ে স্পষ্ট — লাঙল টেনে গরুর জোয়ালে বাঁধা কৃষকের ঘাম ঝরানো চিত্র এখন প্রায় অদৃশ্য। বাংলার গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লাঙল-জোয়ালের যুগল প্রয়োগ, যা আজ একমাত্র স্মৃতির পাতায় রহে।
একসময় বাংলার কৃষিকাজের পরিচায়ক ছিল লাঙল ও জোয়াল। কৃষকের শক্ত হাতে লাঙলের হাতল ধরতে দেখলে বোঝা যেত জমির প্রতি তার ভালোবাসা। গরুর ঘাড়ে জোয়াল বেঁধে, মাঠে কাঁদামাটির সুগন্ধের মাঝে চাষাবাদের সেই প্রথা ছিল বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ স্পন্দন। কৃষকরা বিশ্বাস করতেন, লাঙল দিয়ে জমি চাষ করলে তা হয়ে ওঠে উর্বর এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বর্তমান সময়ে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারসহ নানা আধুনিক যন্ত্রের আগমন কৃষি পদ্ধতিকে সহজ ও সময়সাশ্রয়ী করেছে। কম পরিশ্রমে কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ধীরে ধীরে পুরোনো প্রথা পশ্চাৎপটে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে শুধু লাঙল-জোয়ালই হারিয়ে যাচ্ছে না, বরং মানুষের মাটির সঙ্গে প্রাণবন্ত সম্পর্কও দূর্বল হয়ে পড়ছে।
আজও কিছু প্রবীণ কৃষক লাঙল-জোয়ালের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “গরুর জোয়ালের আওয়াজে পল্লীজুড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসত। লাঙলের ফলা মাটি ছুরে কাটলে মনে হতো আমরা মাটির সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তুলছি।” এই স্মৃতিগুলো এক প্রজন্মের নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন্ত গল্প।
যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার যেমন কাজের গতি বাড়িয়েছে, তেমনি এর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে; গরুর সংখ্যা কমে যাওয়ায় গোবর সার তৈরির ঐতিহ্যও বিলীন হতে চলছে। লাঙল-জোয়ালের ব্যবহার ছিল প্রকৃতি ও মানুষের নিখুঁত সমন্বয়ের নিদর্শন; হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু প্রযুক্তির পরিবর্তন নয়, একটি সংস্কৃতির ক্ষতি।
এই ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবন করা সহজ নয়, তবুও আমাদের উচিত স্মৃতির মাঝে এই ইতিহাস সংরক্ষণ করা। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ আবার ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির দিকে ফিরে এসে বাংলার মাটিতে পুরোনো দিনের গন্ধ ফিরিয়ে আনবেন। লাঙল-জোয়াল হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতির গুরুত্ব চিরন্তন। সেই ঐতিহ্যের গল্প যেন কখনো মুছে না যায়, এজন্য আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।