ঢাকা | বুধবার | ২৩শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৮শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

গণমাধ্যমের জন্য সমন্বিত আইনের প্রস্তব বিজেসির

সাংবাদিক ও গণমাধ্যমে কর্মীদের আর্থিকসহ সব ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি সমন্বিত

আইনের প্রস্তাব করেছে বিজেসি। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা

শেষে এই প্রস্তাব দিয়েছে সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠনটি।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে শনিবার (৫ জুলাই) রাজধানীর

কারওয়ান বাজারে ডেইলি স্টার ভবনে সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্র (বিজেসি) তাদের

পর্যালোচনা তুলে ধরে সেমিনারের আয়োজন করে। বিজেসির এই সেমিনার আয়োজনে সহায়তা করেছে

বিবিসি মিডিয়া এ্যাকশন।

সম্প্রচার সাংবাদিকদের অধিকার, নীতিমালা, আর্থিক সুরক্ষা, মালিকানা কাঠামো এবং

সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন

পেশাজীবী, নীতিনির্ধারক, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদ ও আইনবিদরা অংশ নেন।

বিজেসি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় জানিয়েছে, কমিশনের প্রতিবেদনে

সম্প্রচার মাধ্যমকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কমিশন সাংবাদিকের যে সংজ্ঞা

দিয়েছে তা অস্পষ্ট। সম্প্রচার সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সাংবাদিকের

সংজ্ঞা স্পষ্ট ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি জানিয়েছে বিজেসি।

কমিশন তাদের সুপারিশে সাংবাদিকদের জন্য অভিন্ন ন্যূনতম বেতন কাঠামোর সুপারিশ করেছে,

যা হবে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বেতনের সমান। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, উৎসব

ভাতা, ফোন ও ইন্টারনেট বিল, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ঝুঁকিভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর

ভাতা বা গ্রাচ্যুইটি প্রাপ্তির কথাও বলা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের সংবাদপত্র ও

চাকুরির শর্তাবলী আইন ও শ্রম আইন বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যম দুই ধরণের গণমাধ্যম এবং তাদের জন্য অভিন্ন বেতন কাঠামো

সংগতিপূর্ণ নয় বলেই বিজেসি মনে করে। তাছাড়া ১৯৭৪ সালের আইন শুধুই সংবাদপত্রের জন্য।

তাই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে তা সংশোধন করতে হবে। শ্রম আইনেও সংবাদপত্র ও

সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা বিধান যুক্ত করতে হবে বলে বিজেসি মনে করে।

সম্প্রচার মাধ্যম গণমাধ্যমের জন্য জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব

সংস্কার কমিশন দিয়েছে সেখানে সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা বিভাগ রাখার প্রস্তাব

করেছে বিজেসি। সম্প্রচার মাধ্যেমর লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আগেই কর্মীদের বেতন

কাঠামো, নীতিমালা ও আর্থিক সচ্ছতার বিষয়ে অঙ্গীকারনামা জমা দেয়ার প্রস্তাব করেছে

বিজেসি।

সাংকবাদিকদের জন্য একটি ‘কোড অব এথিকস’ প্রণয়নের দাবি জানিয়ে বিজেসি বলেছে, এ বিষয়ে

সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে প্রস্তুত সংস্থাটি। এক হাউস এক মিডিয়ার যে

প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করে বিজেসি। তবে সংস্কার

কমিশনের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বিজেসি বলেছে, সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা

থাকা উচিত। বিজেসি মনে করে সাংবাদিক নিবন্ধনের যে প্রস্তাব কমিশন করেছে তা সাংবাদিক

নিপীড়নের নতুন উপায় হয়ে উঠতে পারে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জৈষ্ট্য সাংবাদিক খায়রুল আনোয়ার

মুকুল। আলোচনায় অংশ নেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন,

ফাহিম আহমেদ, ট্রাস্টি, বিজেসি; সিইও, যমুনা টেলিভিশন, নাজমুল আশরাফ, এডিটর ইন চিফ,

চ্যানেল ওয়ান, শাহনেওয়াজ পাটোয়ারী, হেড অফ প্রোগ্রাম, আর্টিকেল ১৯, জাফরুল,

আইনজীবী। এ আয়োজনে বক্তব্য দেন মো. আল মামুন, কান্ট্রি ডিরেক্টর, বিবিসি মিডিয়া

অ্যাকশন।

কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন বিজেসির নির্বাহী মিলটন আনোয়ার।

বিজেসির সদস্য সচিব ইলিয়াস হোসেনের সঞ্চালনায় সেমিনারের সভাপতি ছিলেন বিজেসির

ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজানুল হক রাজা।

স্বাগত বক্তব্যে বিজেসির সদস্য সচিব ইলিয়াস হোসেন বলেন, গণমাধ্যমকে গণমানুষের

মাধ্যম করতে হলে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিবাজদের

খপ্পর থেকে গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। যুগোযযোগী করে গড়ে

তুলতে হবে গণমাধ্যমকর্মীদেরকেও।

বিজেসির ট্রাস্টি ও যমুনা টেলিভিশনের সিইও ফাহিম আহমেদ প্রেস সচিবকে উদ্দেশ করে

বলেন, সংষ্কার কমিশনের যে প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলোকে যেন তিনি

গুরুত্ব দেন। প্রয়োজনে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করারও আহবান জানান তিনি। সাংবাদিক

ও গণমাধ্যমের স্বার্থের বিষয়গুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ারও আহবান জানান ফাজিম

আহমেদ।

চ্যানেল ওয়ানের এডিটর ইন চিফ বলেন, মালিকরা অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন

কিনা সেবিষয়ে সাংবাদিকদের সিদ্ধান্ত উচিত। সেই মালিক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা

দুর্বৃত্তকারী যেই হোন না কেন। তিনি বলেন মালিকদের বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিকদের

চাকরি চলে যায়। সহকর্মীরাও চাকুরি বাঁচাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকেন।

সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এছাড়াও নাজমুল আশরাফ বলেন, সরকার বা রাজনৈতিক দল সবসময় সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের

পক্ষে থাকবে এটা ভাবার কোনো কারণ নাই।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণমাধ্যম সংস্কার

কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বলেন, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে।

সাংবাদিকতায় থাকতে হবে কোড অব কন্ডাক্ট। উপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

গণমাধ্যমও যেন অন্যদের দ্বারা চালিত না হয় এমন প্রত্যাশা তার।

তিনি আরও বলেন, ইতিবাচকভাবে সাংবাদিকরা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে।

সাংবাদিকরা একসময় এক জায়গায় দাঁড়ালে যে সবাই কথা শুনতে বাধ্য হত; সেই জায়গাটা আর

নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যখন সাংবাদিকদের কথায় ভুল তথ্য

থাকবে না, সাংবাদিকদের কেনা যাবে না তখন তাদের কথা সবাই শুনবে।

সভাপতির বক্তব্যে বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক

সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা সম্ভব না। গত শাসনামলে কিছু

সাংবাদিক সরকারের কাছাকাছি যাওয়ার প্রতিযোগিতায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এই

সরকারের আমলে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যেসব পত্রিকার নাম কেউই জানে না তাদের অনেকের সার্কুলেশন আসে দুই

থেকৈ আড়াই লাখ। সেটা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। জনমনে সাংবাদিকদের

ওপর এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।

রেজোয়ানুল হক আরও বলেন, এই অনাস্থার মুল কারণ দলবাজী, ধান্দাবাজি, স্বার্থবাদিতা।

এগুলো সাংবাদিকদের একাংশের ভেতরে ছিল, মালিকদের একাংশের ভেতরেও আছে।

তিনি আরও বলেন, রুঢ় বাস্তবস্তা হল মিডিয়া এখন চালাচ্ছে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং

ডিপার্টমেন্ট। বিজ্ঞাপনের কারণে নিউজও কমে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের ইউনিয়ন ভেঙে দুই তিন

টুকরো হয়েছে। মালিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। এই স্বার্থের দ্বন্দ সাংবাদিকদের এক জায়গায়

আসতে দিচ্ছে না। শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিলে হয়ত এটা সম্ভব হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, কমিশন প্রিন্ট মিডয়া নিয়ে যত কথা বলেছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নিয়ে তত

বলেনি। এই সরকারের আমলেই যেন গণমাধ্যম সংষ্কার কমিশনের কাজ শুরু হয় সেই প্রত্যাশার

কথাও জানান তিনি।

সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবি উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, শফিকুল

আলম। তিনি বলেন, ভয়ের সংষ্কৃতি বন্ধ করার চেষ্টা করেছে এই সরকার। সাংবাদিকতায় কেউ

হুমকি পেলে তাকে যেন জানানো হয়।

প্রেস সচিব আরও বলেন, ১১ মাসে তিনি চেষ্টা করেছেন কোনো সিক্রেট এজেন্সি বা

ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি যেন সাংবাদিকদের প্রভাবিত না করে। সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে

রাখাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব৷ তিনি মনে করেন সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই হোক না

কেন গেটকিপিংয়ের পলিসি ঠিক থাকতে হবে। সাংবাদিকদের ন্যূন্যতম বেতন ৩০ হাজার টাকা

করার আহবান জানান তিনি।

প্রেস সচিব মনে করেন ওয়েজ বোর্ড করতে দেরী হলেও আগে সাংবাদিকদের ন্যূন্যতম বেতনের

বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকরা যেন কোন মিথ্যা বা অপতথ্য প্রচার করতে না

পারে— সেবিষয়েও লক্ষ্য রাখতে, বলেন প্রেস সচিব।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বিপ্লবের ফসল। যেকোনো সরকারেরই ভুলত্রুটি হতে পারে। কাজের

মধ্য দিয়ে সেগুলো শুধরিয়ে এগোতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকারকে অনেক কিছুকে গুরুত্ব

দিতে হচ্ছে। তাই কিছু কাজে দেরী হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, একটি প্রকাশনার মাধ্যমে পরে জানানো হবে যে কোন কোন মন্ত্রণালয়ে এই

সরকার কি কি কাজ করেছে। প্রেস সচিব আরও বলেন, গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতায় অনেক অনিয়ম

হয়েছে। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে টিভি বা নিউজ মিডিয়া ব্যর্থ ছিল। এটা নিয়ে অনেকে

অনেক কথা বলছে। নতুন করে যখন আবার কেউ ব্যর্থ হয়, তখন সেই মেমোরি চাঙ্গা দিয়ে উঠে।

এর ফলে অনেকে প্রটেস্ট করেন, অনেকে মার্চ করেন। তখন অনেকে বলেন যে মব তৈরি হচ্ছে।

বর্তমান সরকার জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতার তদন্ত করবে বলেও

জানান তিনি। আগের ব্যর্থতার অধ্যায়কে বাদ দিয়ে নতুনভাবে শুরু করার প্রত্যাশার কথাও

জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।