গাজা উপত্যকার গাজা শহরে ইসরায়েলের মারাত্মক ও বিস্ফোরক ভর্তি ‘রোবট’ ব্যবহার করে হামলা চালানো হচ্ছে, যা সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এই অত্যাধুনিক অস্ত্রের উপস্থিতিতে শহরবাসী এখন দিশেহারা, ঘর-বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সম্প্রতি গাজা শহরে এক ফিলিস্তিনি নাগরিক হামজা শাবান (৩৫) বলেন, আমি যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, তখনই বুঝতে পারলাম, রোবটটি কোথায় আছে। প্রথমে ধরা পড়েনি, পরে দেখা গেল এটি প্রায় ১০০ মিটার দূরে। এরপর আরেকটি বিস্ফোরণে আমি জানালা থেকে দুই মিটার দূরে ছিটকে পড়ি। তিনি বললেন, আমি হামাগুড়ি দিয়ে শোবার ঘরের দিকে দ্রুত পালাতে থাকলাম; সেই সময় আমি উড়ন্ত ধ্বংসাবশেষের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, যা একটার পর একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছিল।
বর্তমানে গাজা শহরের বাসিন্দাদের জন্য এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে আসছে। গত মাসে ইসরায়েল গাজায় হামলা আরও জোরদার করে, এমনকি প্রায় প্রতিরাতে বড় বড় বিস্ফোরণের শব্দে শহর কেঁপে ওঠে। এই হামলায় ইসরায়েল এখন দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক ভরপুর ‘এপিসি’ বা আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার নামের চালনাযুক্ত যান পাঠাচ্ছে, যা আরামবাগে স্থাপনা ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই যানগুলো রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক ভর্তি ব্যারেল ফেলে, পরে তা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। হামজা শাবান আরও বলেন, সাধারণত রাত ১০টার পর থেকে ১১টার মধ্যে বিস্ফোরণ শুরু হয়; প্রতি রাতে ৮ থেকে ১০টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এসব বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী যে, পুরো ভবন গুঁড়িয়ে দেয় এবং আশপাশের এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
হামজা ইসরায়েলের যুদ্ধের ভয়ের সঙ্গে পরিচিত, তার ভাষায়, ‘এগুলো বিমান হামলার চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই রোবটের ধ্বংসযজ্ঞে অতীতে দেখা যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধের অন্যান্য অস্ত্রের তুলনা হয় না। এগুলো অনেক বেশি ক্ষতিকর ও মারাত্মক।’
অবশ্য, হামাস এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করলেও ইসরায়েল তা মানে না। তার পর থেকে তারা গাজা দখলের পরিকল্পনা চালাচ্ছে, যা শুরু হয়েছে গাজা শহর থেকে। এর ফলে গত কিছু সপ্তাহে গাজায় আকাশ ও স্থল হামলা বেড়ে গেছে। সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০টি বিস্ফোরক রোবট পাঠানো হয়েছে।
অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই বিস্ফোরক রোবটের ব্যবহারে প্রতিদিন কয়েকশো পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, এবং প্রতিটি রোবটের মধ্যে প্রায় সাত টনের প্রবল বিস্ফোরক থাকছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গাজা শহরের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা ব্যাপকভাবে ধ্বংসের মুখের মধ্যে পড়েছে।
ইউরো-মেডিটেরিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরিং সংস্থার তথ্যে, এই অত্যাধুনিক রোবটগুলো এত দ্রুত এবং ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যে, গাজার মানচিত্র থেকে পুরো শহরটি ‘মুছে ফেলার’ পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে। যদি এই দিক পরিবর্তন না হয়, তবে অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী দুই মাসের মধ্যেই শহরের বাকি অংশও ধ্বংসের শিকার হতে পারে। আন্তর্জাতিক স্বার্থের অভাব ও চাপের অভাবের কারণে এই সময়সীমা আরও কমে আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ভারতের সংবাদমাধ্যম মতে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনী এই বিস্ফোরক রোবটের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি করেছে, এবং আরও শত শত রোবট শহরে পাঠানো হচ্ছে। এই যানগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী, মূলত অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য তৈরি, যা হামাসের অস্ত্র ও জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ কমিয়ে আনার পাশাপাশি, ইসরায়েলি সেনাদের ঝুঁকি কমাচ্ছে সরাসরি যুদ্ধে।
সুতরাং, গাজার পরিস্থিতি এখন খুবই মারাত্মক ও উদ্বেগজনক। উন্নত প্রযুক্তির এই অস্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের ধরণ পুরোপুরি বদলে গেছে, যা দুর্যোগের নতুন মাত্রা যোগ করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য।