গাজা উপত্যকা, যা মধ্যপ্রাচ্যের এক অনিষ্ঠ ভূমি, সেখানে আজ জন্ম নেওয়া শিশুরাও ভোগে এক চরম দুর্দশা। যেখানে জন্ম হওয়া মানেই পরিবারের আনন্দের উৎস, সেখানে গাজায় একটি শিশুর আগমন নিয়ে আসে গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা। তাদের বাবা-মারা প্রথম ভাবেন, ‘‘এই শিশুকে কীভাবে খাওয়াব?’’ আর কখনো বোমায় নিহত হবে—এই ভয়ে তারা উদ্বিগ্ন থাকেন।
গাজার দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক যুদ্ধে হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নেওয়া সহ বিশ্ববাসীর নজরেও এসেছে এই মানবিক সংকট। সম্প্রতি ইসরায়েলের দ্বারা গাজার ওপর মানবিক সহায়তা ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহে বাধা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বাস্তবতা এখন ঠিক তেমনই।
গাজার শিশুদের অবস্থা এতটাই করুণ যে এক চিকিৎসক বলেছেন, ‘‘ওরা এখন শুধু চামড়া আর হাড়ের মতো হয়ে গেছে।’’ বর্তমানে সেখানে মানবিক সহায়তা সীমিত থাকায় শত শত শিশু মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে।
খান ইউনিসে নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমদ আল-ফাররার ভাষ্যে, ‘‘আমাদের ওয়ার্ডে শিশুখাদ্যের মজুদ মাত্র এক সপ্তাহের জন্যই যথেষ্ট। বিশেষভাবে অপ্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের জন্য নির্দিষ্ট ফর্মুলা খাদ্যের ঘাটতি মারাত্মক। বাধ্য হয়েই আমরা সাধারণ শিশুখাদ্য ব্যবহার করছি, যা অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয়। অনেক শিশু হাসপাতালেও না পৌঁছে দুধ পান করতে পারছে না।’’
২৭ বছর বয়সী একজন মা, হানাআ আল-তাওয়িল, বর্তমানে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানিয়েছেন, নিজের অপুষ্টির কারণে স্তন্যদানে ব্যর্থতা ও শিশুখাদ্যের অভাবে তার ১৩ মাসের সন্তান গম্ভীর খাদ্য সংকটে পড়েছে। তার চিকিৎসকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শিশুটির বিকাশ অন্য শিশুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ৬৬ জন ফিলিস্তিনী শিশু অনাহারে মারা গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ পরিস্থিতি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহার হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে যে তারা শিশুখাদ্য ও মানবিক সহায়তা আনার পথে বাধা দিচ্ছে না, উল্টো সম্প্রতি গাজায় হাজার টনের বেশি শিশুখাদ্য পাঠানো হয়েছে। তবে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, অনেক সময় শিশুখাদ্য গোপনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তা নিয়ন্ত্রণের নামে জব্দ করা হয়।
বর্তমান খাদ্য সংকটে গাজায় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেক মায়েরই নিজের অপুষ্টির কারণে সন্তানকে স্তন্যদান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিশুখাদ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, অথচ বাজারে ফর্মুলার দাম আকাশছোঁয়া। এক কৌটার দাম প্রায় পঞ্চাশ ডলার, যা স্বাভাবিকের দশগুণ বেশি।
নূরহান বারাকাত, তিন সন্তানের জননী, বলেন, ‘‘আমি প্রথম এক মাস স্বাভাবিকভাবে স্তন্যদান করতে পেরেছিলাম, কিন্তু খাবারের অভাবে তা আর চালিয়ে যেতে পারছি না।’’ তার মতো অসংখ্য মা আজ এই সংকটের মধ্যে হারিয়েছেন তাদের সন্তানের যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য।
গাজার শিশুদের এই সংকটের দূরবস্থা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সচেতনতা ও পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক। না হলে হাজার হাজার শিশুর জীবন ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর তাদের কষ্টের গল্প ইতিহাসের একটি বিষাদময় অধ্যায় হিসেবে সমস্ত বিশ্বের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করবে।