ঢাকা | মঙ্গলবার | ২২শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৭শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

জয়পুরহাটের বাইগুনি: ক্ষতবিক্ষত এক ‘কিডনির গ্রাম’

বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামটি ইতোমধ্যে ‘এক কিডনির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিনের মতো অসংখ্য মানুষ কিডনি বিক্রি করে জীবিকার আশায় নিজের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যত বাজি রেখেছেন। ২০২৪ সালে তিন সন্তানের মঙ্গল কামনায় এবং বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি নিজের একটি কিডনি ভারতের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। কিন্তু সেই টাকা দ্রুত শেষ হয়ে যায়, বাড়ির কাজ বন্ধ পড়ে এবং দীর্ঘ দিন থেকে চলতে থাকা পেটের ব্যথা এখনো তাকে কষ্ট দেয়।

সফিরুদ্দিন প্রতিদিন হিমাগারে দিনমজুরের কাজ করে বাঁচার লড়াই চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি শুধু আমার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য এসব করেছি।’’ তবে দালালদের প্ররোচনায় ভিসা ও চিকিৎসা পাপড়ি জালিয়াতির মধ্য দিয়ে ভারতে গিয়ে ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি হয়, যার কারণে কিডনি গ্রহণকারী ব্যক্তির পরিচয় এখনও তার অজানা।

ভারতের আইন অনুযায়ী কিডনি প্রতিস্থাপন কেবলমাত্র নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈধ হলেও, দালালরা ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট ও নকল আইডি তৈরি করে অবৈধভাবে এই চক্র চালায় বলে জানা গেছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মনির মোনিরুজ্জামান এই প্রতারণার প্রক্রিয়া “নাম বদল, জাল নোটারি সার্টিফিকেট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নকল” উল্লেখ করেছেন।

বাইগুনি গ্রামে কিডনি বিক্রির এই প্রবণতা নতুন নয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন এবং বেশিরভাগ বিক্রেতাই মধ্যবয়সি পুরুষ, যাদের প্রভাব প্রধানত অর্থনৈতিক সংকট, ঋণ, মাদকাসক্তি ও জুয়ার কারণে।

সফিরুদ্দিনের মতো অনেকেই চিকিৎসার পর সঠিক পরিচর্যা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন, পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশনও দালালরা ফিরিয়ে দেয় না। এর ফলে তাঁরা শারীরিক ও মানসিক সংকটে পড়েন।

ভারতের ধনী রোগীরা অবৈধ কিডনি কেনার মাধ্যমে দ্রুত রোগ মুক্তির চেষ্টা করেন, যেখানে ২০২৩ সালে মাত্র ১৩,৬০০টি কিডনি অপারেশন হয়েছে, যদিও প্রতিবছর ২ লাখের বেশি মানুষ শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগে ভুগছেন।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘অনেকে জানাশোনা সত্ত্বেও বিক্রি করেন, কিন্তু অনেকেই প্রতারিত হয়।’’ মোহাম্মদ সাজল নামে একজন বিক্রেতা টাকার ফাঁদে পড়ার দুঃখ কাঁটছেন, যিনি কিডনি বিক্রি করে চুক্তির মূল্য পাননি এবং পরে নিজেই দালাল চক্রে জড়িয়ে পড়েন।

দুত্তর ভারতের হাসপাতালগুলো এই অবৈধ কারবারে সক্রিয় থাকলেও বাংলাদেশের এবং ভারতের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। গবেষক মনিরুজ্জামান এবং কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ এই সমস্যাটি দ্রুত সমাধানের জন্য জোর দিয়ে বলেন, প্রয়োজন সুশৃঙ্খল ও মানবিক ব্যবস্থা, যেখানে বিক্রেতাদের স্বাস্থ্যের পূর্ণ যত্ন এবং আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।

বাইগুনির বিক্রেতাদের জীবন এখন অনেকাংশেই হারানো স্বপ্ন আর তিক্ত বাস্তবতার সংকটে পর্যবসিত। সফিরুদ্দিনের মতো তারা আজ একাকীত্ব ও বিষণ্নতায় কাটাচ্ছেন দিন, যাদের পাশে দাড়ানোর কেউ নেই। তার ভাষায়, ‘‘তারা আমার কিডনি নিয়ে গেল, আর আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল।’’