ঢাকা | বুধবার | ২৩শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৮শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

জয়পুরহাটের বাইগুনি গ্রাম: দারিদ্র্যের সঙ্কটে কিডনি বিক্রির মর্মান্তিক গল্প

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রাম বাংলাদেশের একটি ছোট গ্রাম, যা অসংখ্য মানুষের কিডনি বিক্রির কারণে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন এ গ্রামের একজন দিনমজুর। তার অসমাপ্ত ইটের বাড়ির সামনের বারান্দায় বসেই তিনি জীবনের কষ্টগাথা শোনান। ডান পাশের পেটের নিচের অংশে চাপ দিলে এখনও ব্যথা অনুভব করেন তিনি। ২০২৪ সালে, পরিবারের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে এবং নিজের তিন সন্তানের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করতে, তিনি নিজের একটি কিডনি ভারতীয় একজন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। এর বিনিময়ে পান সাড়ে তিন লাখ টাকা।

কিন্তু সেই টাকা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, বাড়ির কাজ এখন থমকে আছে। তার শরীরের সেই ব্যথা এবং অস্বস্থি প্রতিদিন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এই সিদ্ধান্তের মূল্য কতটা ভারি ছিল। বর্তমানে সফিরুদ্দিন একটি হিমাগারে দিনমজুরি করছেন, ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়া শরীর নিয়ে প্রতিদিনের কাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্যই এই সমস্ত করেছি।’

প্রথমে ভয় ও সংশয়ের মধ্যে থাকা সফিরুদ্দিন দালালদের প্ররোচনায় রাজি হন। ভিসা, ফ্লাইট এবং হাসপাতালের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তারা নিজেরাই কব্জা করে দেয়। ভারতে ভিসায় যাওয়ার সময় তার পাসপোর্ট ছিল নিজের নামে, কিন্তু হাসপাতালের কাগজপত্রে তাকে রোগীর আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়। এমনকি ভুয়া আইডি, নকল জন্মসনদ ও নোটারি সার্টিফিকেটও তৈরি করা হয়। যে ব্যক্তিকে তিনি কিডনি দান করেছেন, তার পরিচয় আজও তার অজানা।

ভারতের আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন সাধারণত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈধ, তবে সরকার অনুমোদন দিলে বাইরে থেকেও সম্ভব। কিন্তু প্রতারকরা আইন পাশ কাটিয়ে ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে, কখনও কখনও ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট পর্যন্ত বানায়। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং WHO এর অঙ্গসংগঠন ‘অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন টাস্কফোর্স’-এর সদস্য মনির মোনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতারণার কৌশলগুলো প্রায় একই রকম—নাম পরিবর্তন, ভুয়া নোটারি সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্রের জাল কপি ইত্যাদি।’

বাইগুনি গ্রাম মোটামুটি ছয় হাজার মানুষের বসবাস, যেখানে এত বেশি মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন যে তাকে ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে ডাকা হয়। ২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। বেশিরভাগই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সি পুরুষ, যারা দারিদ্র্যের চাপে এই পথে পা দিয়েছেন। কেউ কেউ ঋণ, মাদকাসক্তি বা জুয়ায় আসক্তির কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সফিরুদ্দিন অভিযোগ করেন, অপারেশনের পর তার পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশনগুলো ফেরত দেওয়া হয়নি। সে সময় পর্যাপ্ত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা সুবিধা পাননি। এমন অনেক সময় দালালরা কিডনি বিক্রেতাদের কাগজপত্র তছনছ করে রাখে, যাতে তারা চিকিৎসা দাবি বা কোনো অভিযোগ করতে না পারেন।

ভারতে এসব বিক্রি করা কিডনি ধনী রোগীদের কাছে যায়, যারা বৈধ পদ্ধতিতে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে চান না। ২০২৩ সালে ভারতে মাত্র ১৩,৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, অথচ বছরে প্রায় ২ লাখ লোক শেষ ধাপের কিডনি রোগে আক্রান্ত হন।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘অনেকে জেনে-বুঝেই বিক্রি করেন, তবে বেশিরভাগই প্রতারিত হন।’ অনেক সময় বিক্রেতারা পুরো টাকা পাওয়াও সম্ভব হয় না। মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম), যিনি ২০২২ সালে দিল্লির এক হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করেন ১০ লাখ টাকা চুক্তিতে, কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা পান। পরে সে নিজে কিডনি বিক্রেতাদের খুঁজে ভারতে পাঠানোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তবে কিছুদিনের মধ্যে সে চক্র থেকে বেরিয়ে আসে। বর্তমানে তিনি ঢাকায় রাইড শেয়ারিং চালক হিসেবে কাজ করছেন, কিন্তু অতীতের ক্ষত তাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়।

ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদেশের বাধ্যতামূলক সমন্বয়ের অভাবে এসব অবৈধ উন্নয়নশীল হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সরকারি পক্ষ কখনও দাবি এড়িয়ে যায়, আবার কিছু হাসপাতাল জেনে-বুঝেই ভুয়া কাগজপত্র গ্রহণ করে বেশি আয় করার জন্য।

২০১৯ সালে ভারত সরকারের একটি তদন্তে কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২০২৪ সালে দিল্লিতে ড. বিজয়া রাজাকুমারিকে আটক করা হয়, যিনি ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ জন বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। তবে এসব উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পুরো পরিবেশে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি।

দালাল মিজানুর রহমান জানান, প্রতিটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে মোট খরচ হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, যার মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা বিক্রেতাদের মধ্যে বিতরণ হয়, বাকি টাকা দালাল, কাগজপত্র প্রস্তুতকারী, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের পকেটে চলে যায়। প্রলোভন দেখিয়ে বা সুযোগের আশায় অনেককেই এই ফাঁদে ফেলা হয়। অনেক সময় কাজের সন্ধানে ভারতে যাওয়া মানুষ অপারেশনের পর ছেড়ে দেয়া হয়।

ভারতের কিডনি ওয়ারিয়ার্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, ‘আইন থাকা সত্ত্বেও অঙ্গদানের এই ব্যবসা কালোবাজারির রূপ নিয়েছে, কারণ চাহিদা থামছে না।’ তিনি মনে করেন, যদিও পুরোপুরি অঙ্গদান বন্ধ করা সম্ভব না, তবুও একটি স্বচ্ছ ও মানবিক ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে কিডনি বিক্রেতাদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অপারেশনের পর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

আরোদিকে, বাইগুনি গ্রামে সফিরুদ্দিন এখনো নিজের অর্ধনির্মিত বাড়ির বারান্দায় বসে ভেবে চলেছেন, কবে তার স্বপ্নের ঘর সম্পূর্ণ হবে। তিনি ভেবেছিলেন, এই পথই পরিবারের জন্য স্বস্তির উৎস হবে, কিন্তু এখন তিনি এক অসুস্থ পিতা, যার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তার কণ্ঠে শুধু তিক্ততা ঝরে পড়ছে—‘তারা কিডনি নিয়ে ফেলে চলে গেলো আমাকে।’