প্রবল বর্ষায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছেন বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন
শিবিরে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গারা। তহবিল সংকটের কারণে এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে বলে
সতর্ক করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরে জীবন সবসময়ই
কঠিন। তবে, বর্ষাকালে এই দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। বর্ষার মৌসুমে নানা ধরনের দুর্ভোগের
মধ্যে যেতে হয় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে। ভূমিধস, জলাবদ্ধতা, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি
সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ নানা দুর্ভোগ যেন এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা।
ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের দিয়ে রাস্তা-পাহাড়ি
ঢাল মেরামত ও অন্যান্য জরুরি কাজ করিয়ে বিনিময়ে তাদের কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হতো।
এতে তাদের সংসার চালাতে কিছুটা হলেও সহায়তা হতো। কেউ কেউ বলছেন, আগে এই আয় দিয়ে
পরিবারে বাড়তি খাবার আনা যেত। কিন্তু এখন সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। বৈশ্বিক তহবিল
সংকটের কারণে এই কার্যক্রম বন্ধের পথে রয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, আগে এমন প্রকল্পে যেখানে ৩০ থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা কাজ করতেন, এখন
সেখানে ৭-৮ জনকেও সুযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিবিরের রাস্তাঘাট, সেতু, পয়ঃনিষ্কাশন
ব্যবস্থা ও টয়লেট মেরামত কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বর্ষাকালে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য
ও নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
ইউএনএইচসিআরের ওই প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তায় অর্থ বরাদ্দ কমানোর ফলে
শরণার্থী জনগোষ্ঠীগুলোর এর ওপর সরাসরি প্রভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর সম্পূর্ণভাবে
নির্ভরশীল রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও আশ্রয়ের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে
সহায়তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
জীবনের অন্যতম ভরসা
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা জাহিদ আলম নামের ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন,
আমরা মাসে যে পরিমাণ খাবার পাই, তা খুবই সীমিত। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে যে সামান্য
আয় হতো, তা দিয়ে নিজের দুই সন্তানের জন্য বাড়তি কিছু খাবার কিনতে পারতাম। এখন সেটাও
আর সম্ভব হচ্ছে না।
পড়ুন: রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ:
রাষ্ট্রদূত তারেক
জাহিদ ও তার স্ত্রী—দুজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ তাদের পুষ্টি
সহায়তার পাশাপাশি সামাজিকীকরণের সুযোগও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তা বন্ধের
পথে।
আফরোজা সুলতানা নামের ব্র্যাকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি কেবল একটি কর্মসূচি ছিল
না, এটি ছিল তাদের জীবনের অন্যতম ভরসা। এটি শুধু পারিশ্রমিকই দেয়নি, মানুষকে
আত্মমর্যাদা দিয়েছে, পরিবার চালানোর সামর্থ্য দিয়েছে এবং ন্যূনতম চাহিদা পূরণের
বিকল্প ব্যবস্থাও তৈরি করেছে।’
তিনি জানান, এই কর্মসূচি বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। অনেক শিশু বিদ্যালয়
থেকে ঝরে পড়ছে, কেউ কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, আবার অনেকে বিপজ্জনক পথে
বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাও করছেন।
অবকাঠামোগত ঝুঁকি
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ সহায়তা তহবিলে ঘাটতির কারণে
কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে জরুরি অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে
বর্ষার সময় সড়ক, সেতু, চলার পথ ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত
প্রয়োজনীয় হলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।
২০২৪ সালের শুরুতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রোহিঙ্গা পাঁচ শতাধিক বেশি অবকাঠামো প্রকল্পে
নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু চলতি বছর এই কার্যক্রমের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। ফলে
ভাঙা রাস্তা-সেতু ও বন্ধ ড্রেন এখন শিবিরজুড়ে স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফরোজা সুলতানা বলেন, ‘এসব কারণে শিবিরে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও চলাচল
হুমকির মুখে পড়ছে।’
২৪ বছর বয়সী জয়নব বেগম বলেন, ‘আমাদের আশপাশে একটি ল্যাট্রিন, কিন্তু ভূমিধসের
ঝুঁকিতে সেটি ব্যবহার করতেও ভয় পাচ্ছি।’
পড়ুন: রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে: পররাষ্ট্র
উপদেষ্টা
তহবিল সংকটের কারণে শিবিরে অবকাঠামোগত ঝুঁকির পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবাও
ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে আরও রোহিঙ্গা আসায় মানবিক সেবার ওপর চাপ
বেড়েছে।
চলতি মাসের ১১ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি সতর্ক করে জানায়, অতিরিক্ত তহবিল
পাওয়া না গেলে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, জ্বালানি, খাদ্য সহায়তা এবং শিশুদের
শিক্ষা কার্যক্রম আরও বিঘ্নিত হতে পারে।
এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা।