ঢাকা | শনিবার | ১৯শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৪শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

পাবনায় প্রশাসনের চোখের সামনে বেড়ে চলছে নিষিদ্ধ চায়না জালের ব্যবসা

দেশের জলজ জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষিদ্ধ ‘‘চায়না দুয়ারী’’ জাল। একবার এই জালে মাছ বা অন্য জলজ প্রাণী আটকে গেলে মুক্তি পাওয়া কঠিন। মৎস্য অধিদপ্তর এই জাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা, বি-নগর এবং পুঙ্গলী ইউপির বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে এই চায়না জালের উৎপাদন ও ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রশাসনের চোখের সামনে ঘরের গেট বন্ধ করে নির্বিঘ্নে চলছে জাল তৈরির কারখানা। এই জালের ব্যাপক চাহিদার কারণে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা জাল ও ফ্রেম কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে।

ডেমরা ইউনিয়নের একাধিক কারখানা মালিক সমিতি গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও এই কারখানাগুলো চালাতে ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি জুয়েল রানার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে সহযোগিতা পাচ্ছে। প্রত্যক্ষ অভিযোগ করা হয়েছে যে, তার মদতে এ ব্যবসা নির্ভয়ে চলমান রয়েছে। কারখানার মালিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল নিত্য হাওলাদার, দীপ্ত হাওলাদার, শ্যামল, বিপ্লব, সুশান্ত হাওলাদার, পশু চিকিৎসক পরিতোষ হাওলাদার এবং মাজাট সুইচগেট এলাকার আল-আমিন।

এছাড়াও পুঙ্গলী উপজেলার নারানপুর পশ্চিমপাড়া, কিবরুল, রতনপুর উত্তরপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কালাম, রুহুল আমিন, মালেক, খোয়ালিদ, শাহিন ও মোমিনসহ অনেকেই জড়িত রয়েছেন এই অবৈধ জাল তৈরির কাজে।

স্থানীয়দের দাবি, চেয়ারম্যান জুয়েল রানার ‘‘জুয়েল ফাউন্ডেশন’’ নামে একটি অবৈধ সংগঠনের আড়ালে এই ব্যবসাটি পরিচালিত হয়। এই সংস্থার কোনো বৈধ অফিস বা রেজিস্ট্রেশন নেই। মাঝে মাঝে চাল বিতরণ করলেও সেটি সরকারি তহবিল থেকে নয় বরং ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে এই সংস্থার বৈধ লাইসেন্স না থাকার তথ্যও উঠে এসেছে।

অপরাধমূলক এই কারখানাগুলোতে অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থী কাজ করছে, যারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে জালের উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা হারানো এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে।

রাতের অন্ধকারে জাল তৈরির কাজ চলতে থাকে, যার সুযোগ নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়িরাও। রতনপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিলের ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চায়না দুয়ারের মতো ছোট ফাঁসের জাল মাছের ডিম এবং ছোট মাছসহ অনেক প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই জালের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় দেড় ফুট, যা থেকে কোনো মাছ রক্ষা পায় না।

স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছে কেন এতবার অভিযান সত্ত্বেও কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে না। গত ঈদ এর আগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ একাধিকবার অভিযান চালিয়েও কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি।

ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুয়েল রানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘আমার কোনো কারখানা নেই। ছোট ভাই করত, পরে বন্ধ হয়ে গেছে। ফোনে তিনি স্বীকার করেন, একবার বাড়িতে অভিযান চলাকালীন কিছু জাল জব্দ হয়েছিল, পরবর্তীতে হয়তো আমি কোনো অপরাধ ছাড়া জাল কিনেছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সব জাল পুড়িয়ে ফেলা হয় না, কিছু জাল বিক্রি হয়ে যায়। আমার কাছে প্রমাণও আছে।’’

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ বলেন, ‘‘সম্প্রতি ডেমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ জাল জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে। তবে তিনি বাড়িতে ছিলেন না, থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’’ যন্ত্রপাতি জব্দ না করার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি বাজেট না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও জানান, ‘‘আমার অফিস থেকে কেউ টাকা চেয়েছে কিনা তা জানালে আমি ব্যবস্থা নেবো। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তদন্তের সময় সংশ্লিষ্টদের সম্মান রক্ষা করতে।’’

পাবনার নিষিদ্ধ চায়না জালের উৎপাদন এখন শুধু অবৈধ ব্যবসা নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে, যা কিছু অসাধু প্রশাসনিক সদস্যদের সহায়তায় বিস্তার লাভ করে চলেছে। এখন প্রশ্ন, সরকারি কর্তৃপক্ষ কি এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে, নাকি লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে এ অবৈধ ব্যবসাকে চলতে দেবে?