ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে চিঠি দেব: প্রধান উপদেষ্টা
আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশনকে
সরকার চিঠি দেবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে দেওয়া জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে
হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ। আমরা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক
দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জুলাই সনদ ঘোষণা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল- সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। সে লক্ষ্যে আমরা
বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। কমিশনগুলো বাস্তবায়ন যোগ্য বহু সুপারিশ পেশ
করেছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে;
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে
বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট
স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তারা তাদের মতামত দিয়েছেন। কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি
মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লক্ষ্যে
পৌঁছাতে পেরেছি।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। আমরা আশা করছি এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে
অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করবে এবং এর বাস্তবায়নেও ঐকমত্যে পৌঁছাবে।
পড়ুন: জুলাই ঘোষণাপত্র: চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে ‘রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক
স্বীকৃতি দেওয়া হবে’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর,
জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের
সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে যাতে কখনো কোথাও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ
পাওয়া গেলেই সেটিকে যেন তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই নিমূর্ল করা যায়।
জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে বলে জানান ড.
ইউনূস।
জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে ইউনূস বলেন, আমরা প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার আয়োজন
নিশ্চিত করতে চাই। দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের
অবদানের কথাও তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া নারী ভোটারদের ভোটদান সারাদেশে নিশ্চিত করতে
ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, গত ১৫ বছর ধরে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেনি। এবার অনেক ভোটার থাকবেন যারা
বিগত ১৫ বছর আগে থেকেই জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের ইতিহাসে বড় সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনার পেছনে ছিল
ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো দল যদি গায়ের জোরে
নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে তার চূড়ান্ত পরিণতি কী তা জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের
দেখিয়ে দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা সতর্ক করে বলে, একটা গোষ্ঠী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশের
বাহিরে বসে এবং ভেতরে থেকে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করা গেলে অপশক্তির পরাজয় চূড়ান্ত হবে। নির্বাচন
সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে সমস্যা সমাধানে একটি অ্যাপ প্রস্তুত করা হচ্ছে বলেও জানান
তিনি।
ড. ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির কথাও
উল্লেখ করে বলেন, মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি হলেও নজরদারির মাধ্যমে তা এড়ানো গেছে।
এটিকে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। মূল্যস্ফীত ডিসেম্বরের মধ্যে ৬ শতাংশে নেমে
আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেকর্ড তিন হাজার ৩৩ কোটি ডলার
প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রপ্তানি আয় প্রায় ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে ১১ মাসে
৪০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক পাওনা ও সুদ পরিশোধ করেছে সরকার। আর সরকারের উদ্যোগের ফলে
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে।
তিনি বলেন, ১৬ বছরে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সরকার নামকরা বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানকে
নিয়োগ দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আরো কিছু ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে বলেও আশা প্রকাশ
করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর
উদ্যোগ নিয়েছে। বন্দরকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা গেলে তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই
ভূমিকা রাখবে না, নেপাল, ভূটানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা
রাখতে সক্ষম হবে, বলেন তিনি।
প্রবাসীদের ভিসা জটিলতা নিয়ে তিনি বলেন, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে আমরা
গভীরভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য আরব আমিরাত পুনরায় ভিসা চালু
করেছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য প্রথমবারের মতো মাল্টিপল
এন্ট্রি ভিসা চালু করেছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভিসা জটিলতা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়
এ নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগামী এক বছরে জাপানে এক লাখ বাংলাদেশি তরুণদের
পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, চলতি বছর সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে প্রায় ৮৭ হাজার বাংলাদেশি
সুষ্ঠুভাবে হজ পালন করতে পেরেছেন।
পড়ুন: জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগই হবে আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা: প্রধান উপদেষ্টা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে
তিনি বলেন, আর কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন কোনো রাজনীতি দ্বারা কলুষিত হতে
দেব না, যা পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কমপক্ষে ১০০টি স্কুলে এ
বছরের মধ্যেই ই-লার্নিং চালু হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য
বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের পড়াশোনার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের জন্য সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,
৭৭৫টি পরিবারে ১০০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি আহত ১৩ হাজার ৮০০ জন জুলাই যোদ্ধাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে নগদ টাকা ও চেক
বাবদ মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ৭৮ জন অতি গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধাকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরুস্ক এবং
রাশিয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকাজ হাতে
নিয়েছে।বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বিচারক
নিয়োগ-সহ যেসকল কাজ এ সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে করে যেতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন
তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম প্রধান শর্ত গণমাধ্যমের
স্বাধীনতা। অতীতেমুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচাইতে বড় বাধা হিসেবে কাজ
করেছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এসব বাধা অপসারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য
সাংবাদিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন
করেছে। সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করেছে। নতুন যে আইন প্রণীত হয়েছে তাতে
আগের আইনের নিবর্তনমূলক ৯টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছর মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে ফ্যাসিবাদী সরকার ইন্টারনেট
বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে গোপনে তারা দমন-নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে। অন্তর্বর্তী
সরকার সাইবার সুরক্ষা আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে
মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
গত একবছরে সরকার জুলাইয়ের দাবি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান
উপদেষ্টা। জাতিকে বিভক্ত না হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকায় পরিদর্শনের আহ্বান জানান তিনি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে সকল নাগরিকদের ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষায়
সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার আহ্বানও জানান ড. ইউনূস।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের শুরুতে ২৪’র গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। শহীদ
ও আহতদের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি। এছাড়া মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে
বিমান বিধ্বস্তের প্রাণ হারানো শিশু-শিক্ষকদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
পাশাপাশি তিনি দেশ-বিদেশের চিকিৎসক যারা চিকিৎসায় এগিয়েছে এসেছেন তাদের প্রতি
কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছি। আমাদের
জাতীয় জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে, সংকট দূর
হয়েছে।