ঢাকা | শনিবার | ১৯শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৪শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

বন্যার পর ফের শুরু ফেনীর মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

ফেনীর তিনটি উপজেলার হাজার হাজার বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে নতুন করে জীবনের যুদ্ধে নামেছেন। বন্যার পানি থেকে নেমে গেলেও, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, ভাঙাচোরা আসবাবপত্র এবং পচে যাওয়া খাদ্যসামগ্রী নিয়ে শুরু হয়েছে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই।

আগের বন্যার পানি নামলেও অনেক জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ বেঘী হতেই পারেনি। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৬ জন বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে তাদের নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু করেছেন।

গত ৮ জুলাই থেকে টানা বর্ষণ এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হতে থাকে। এর ফলে, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মোট ১৩৭টি গ্রাম প্লাবিত হলেও ১৩১টি গ্রামে পানি ইতিমধ্যেই নেমে গেছে, ছয়টিতে পানি এখনও রয়েছে।

১২ জুলাই শনিবার, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ফারুক ই আজম ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলার পর জানান, এখন শুধুমাত্র বাঁধ নির্মাণ নয়, ত্রান প্রদানও অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, “মানুষকে বাঁচানোর জন্য এখন ত্রাণ প্রয়োজন, পরবর্তীতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে।”

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ফেনী জেলায় বন্যায় কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে এবং এক হাজারের অধিক ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলি জমি, সড়ক, সেতু ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক ক্ষতি হয়।

জেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, এবারের বন্যায় প্রায় ১০ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষিতে ৫ হাজার ৫৬৪ দশমিক ৬১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রাণিসম্পদে ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরো পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ২ হাজার ৩০০টি পুকুর, দিঘি ও মৎস্য খামার সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩৬টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে পরশুরামে ১৯টি ও ফুলগাজীতে ১৭টি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন বলেন, জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে টেকসই বাঁধ ও নদী খননের কাজ প্রয়োজন।

ফুলগাজীর কমুয়া এলাকার খামারি মো. হারুন জানান, গত বছর বন্যায় প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল। এবারও মুরগি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রতি বারে হয় বাঁধ ভাঙ্গা, পানি প্রবাহিত হওয়া এবং এরপর প্রশাসনের আশ্বাস, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনভিত্তিতে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

ফুলগাজী বাজারের শ্রীপুর সড়কে অন্তত ১৫টি দোকান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দোকান হারানো ব্যবসায়ীরাও এখনও নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে তাদের জীবিকার জায়গা খুঁজছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. আবদুল আলিম বলেন, “একদিনেই আমার দোকান নদীতে হারিয়েছি। দোকানের আয়ের ওপর সংসার চলে, এখন হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে গৃহপরিবারসহ চিন্তিত জীবন কাটাচ্ছি।”

একই এলাকার গৃহবধূ রোজিনা আক্তার বলেন, “পানি নেমেছে, কিন্তু আমাদের ঘরে ঢোকা যাচ্ছে না। মাটি, কাদা এবং বিষাক্ত গন্ধে শিশুরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আশ্রয় কেন্দ্রেও এই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু নেই।”

ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, জেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে শুকনো খাদ্য, গরুর খাদ্য এবং শিশু খাদ্যের জন্য আরও ৪০ লাখ টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছে।

এভাবে, ফেনীর মানুষ বন্যার প্রভাবে নতুন সংকটে পড়লেও, সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তারা জীবনের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে দৃঢ় করেছে।