গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার যুবক সাগর হাওলাদার। তার মৃত্যুয় এখন প্রায় এক বছর কেটে গেলেও, তার মা আম্বিয়া বেগম এবং বাবার হৃদয়ে সন্তানের স্মৃতি এখনও গভীরভাবে অম্লান।
রাত্রি যতই গভীর হয়, মা আম্বিয়া বেগমের চোখ যে কোনো সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেলের স্মৃতিতে ভরে ওঠে। ঘুম ভেঙে ছুটে যান সাগরের কবরের কাছে, যেখানে কখনও নিজের বুকে ছেলের ছবিটি জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদেন।
অপরদিকে বাবা নুরুল হক হাওলাদার মানসিক শোকের ভারে এতটাই অসুস্থ যে তাকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। বাড়ির কেউ যখনই তাকে আঁকড়ে ধরে, তিনি ফুঁফুঁ করে কাঁদতে থাকেন।
পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের mukaan, একমাত্র ছেলের হারানোর শোকে বাবা-মা দুজনেই ভেঙে পড়েছেন। ছেলেবিহীন তারা দুবার ঈদযাপন করলেও কোনো আনন্দ অনুভব করতে পারেননি। সারাদিন চলে মা আম্বিয়া বেগমের মনঃসংযোগ ছেলের স্মৃতিতেই, আর মাঝে মাঝে তিনি চোখের জল ঢালেন।
সম্প্রতি স্বজনরা তাদের ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধানমন্ডির আবাহনী ক্লাবের কর্ণারে পুলিশ বক্সের কাছে সাগর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান দেখিয়েছেন। সেখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে পিচঢালা পথ ধরে ছিটিয়ে ছিল সাগরের রক্তের দাগ, যা দেখে মা-বাবার আবেগে চোখ ভরে উঠেছে এবং তারা প্রবল কাঁদতে শুরু করেন।
সাগরের চাচা মইনুল হোসেন বলেন, “২০২৪ সালের মে মাসে সাগর ঢাকায় গিয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে পরিবারের জন্য বড় ধরনের অর্থ উপার্জন করা, যাতে বাড়ির জন্য বিশিষ্ট পাকা ভবন তৈরি করতে পারে। সেই ভবনে সব সদস্যের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ থাকবে, এবং বোনের লেখাপড়া ও মায়ের জন্য সহায়ক কর্মী থাকবে। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে গেল।”
তিনি আরও যোগ করেন, “সরকার আমাদের সাগরকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, তবে আমরা চাই বিচার, যারা আমার ভাতিজাকে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আমরা তাদের ফাঁসিই চাই।”
সাগরের একমাত্র ছোট বোন মরিয়ম খানম এখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ধীরে ধীরে সে ভাইয়ের শূন্যতাকে উপলব্ধি করছে এবং একাকী এক কোণে বসে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে না, কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না।
বাড়ির বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মজিদ হাওলাদার (৭৫) এখন বাকরুদ্ধ হয়ে নিরব, কান্নার ভাষা হারিয়েছেন। একমাত্র নাতিকে হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
উল্লেখ্য, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগধা গ্রামের বাসিন্দা সাগর হাওলাদার (১৭) ছিলেন এক কৃষক পরিবারে বড় ছেলে। তার বাবা নুরুল হক হাওলাদার বাগধা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী ছিলেন। তাদের সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা চালাতে বাবার আয় যথেষ্ট ছিল না। জীবনের অভিজ্ঞতা ও উন্নতির আশায় সাগর কিশোর সাজপারা নিয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ধানমণ্ডি লেকের তীরে একটি চায়ের দোকানে কাজ করতেন।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় আবাহনী মাঠের কর্ণারে পুলিশ বক্সের কাছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনগণের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে সাগর গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ধানমণ্ডি পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের অভিযোগ, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাগর যথাযোগ্য চিকিৎসাও পাননি, যার পেছনে পতিত আওয়ামী লীগের দোসরদের নিষ্ঠুরতার কথা উঠে আসে।