দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা সৈয়দপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় এক সময়ে প্রায় ১৬ হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী কাজ করতেন। পাকিস্তান শাসনামলেও উত্তরের মানুষের অন্যতম কর্মসংস্থানের কেন্দ্র ছিল এই কারখানা, যেখানে তখনও ১০ হাজার ৫০০’র বেশি শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর্মদিবসের শুরুতে প্রতিদিন ভোরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিকরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় যোগ দিতেন। পার্বতীপুরসহ আশপাশের এলাকায় শ্রমিকদের সুবিধার জন্য বিশেষভাবে চালানো হতো ‘সাটল ট্রেন’। শ্রমিকদের আবাসনের জন্য সৈয়দপুরের নিকটবর্তী সংগলশী ইউনিয়নে অধিকৃত কয়েক শত একর জমিতে বর্তমানে গড়ে উঠেছে উত্তরা ইপিজেড।
শুধুমাত্র একটি কর্মস্থলই নয়, এই কারখানা ছিল শ্রমিক অধিকার আদায়ের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি। ব্রিটিশ দমন নীতির বিরুদ্ধে খেদানো আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খানের শাসন বিরোধী আন্দোলন, এমনকি স্বাধীনতার পরও সরকারবিরোধী নানা লড়াইয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকরা সবসময় অগ্রণী ছিল। এসব সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিল রেলওয়ের ঐতিহাসিক বেলতলা।
সেই সময়ে বেলতলায় রেলওয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারের পাশে সকাল-বিকাল সমাবেশ হতো, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী অংশ নিতেন। মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানীসহ জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পদচারণায় মুখর ছিল এই চত্বর। এমনকি প্রশাসনকেও তখন শ্রমিক আন্দোলনের তাপদায়ে সৈয়দপুর কারখানায় অফিস বসাতে বাধ্য হতে হতো।
কিন্তু সময়ের আবর্তে বেলতলা আজ আর শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল নয়; এটি পরিণত হয়েছে শুধু স্মৃতিচারণের স্থানে। সেখানে আর শ্রমিকদের ব্যানার নেই, নেই হাজারো মানুষের উন্মুক্ত প্রতিবাদের গর্জন। এখন বেলতলায় রয়েছে শুধুই ঘাসফুঁল আর স্তব্ধতা।
বর্তমানে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় অনুমোদিত পদের প্রায় তিন হাজার হলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৮০০ জনের মতো। দীর্ঘদিন নতুন নিয়োগ না হওয়ায় শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক সময় ২২টি উপকারখানার মধ্যে এখন ৯টি বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে এক সময়ে টুলরুম ও মেশিন শপে সাত হাজারের বেশি যন্ত্রাংশ উৎপাদিত হতো, সেগুলো আজ লোকাল মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ফলে কর্মকর্তাদের আর ঠিকাদারদের পকেট মোটা হওয়ায় শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন।
শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানান, অতীতে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের থাকার কারণে কর্মকর্তারা শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী কাজ করার সাহস পেতেন না। কিন্তু এখন কার্যকর আন্দোলনের অভাবে সকল কিছুই আমলাদের ইচ্ছামতো পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেল শ্রমিক ইউনিয়ন কারখানা শাখার সভাপতি, প্রবীণ শ্রমিক নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্থানীয় রেলওয়ে শ্রমিক লীগের বাধায় আমরা বিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বেলতলায় কোনও মিটিং বা মিছিল করতে পারিনি।’
জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী দল, ওপেন লাইন শাখার যুগ্ম সম্পাদক মো. দুলাল প্রামানিক বলেন, ‘একনায়ক হাসিনার নেতৃত্বাধীন রেল শ্রমিক লীগের বাধার কারণে নারাজ শ্রমিকরা ন্যায্য দাবি আদায়ের সুযোগও পাননি। তবে এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসতে চলছে।’
জাতীয়তাবাদী রেল শ্রমিক ও কর্মচারী দল কারখানা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর ধরে স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেতারা বিরোধী শ্রমিক সংগঠনকে বেলতলায় দাঁড়াতে দেননি। সভার ব্যানার ছিড়ে ফেলা, মাইক ছিনিয়ে নেওয়া, মারধর করাও হয়েছে। ফলে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র বেলতলা আজ স্মৃতি চত্বরে রূপ নিয়েছে।’
তবে শ্রমিক নেতাদের প্রত্যাশা, অদূর ভবিষ্যতে এই ঐতিহাসিক চত্বর আবারও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের স্লোগানে মুখরিত হবে।