ঢাকা | বুধবার | ২৩শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৮শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

গাজার শিশুদের অবস্থা সংকটাপন্ন: শুধু চামড়া ও হাড়ের ভর হওয়াই বাকি, জানালেন চিকিৎসকরা

গাজা উপত্যকা, যা মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড, আজ এক নৃশংস বাস্তবতার সাক্ষী। যেখানে শিশুর জন্ম সাধারণ খুশির খবর নয়, বরং ভয়াবহ দুশ্চিন্তার শুরু হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার শিশুরা প্রকৃতির অপরিহার্য নিয়ম অনুযায়ী জন্ম নেয়, তবে সেখানে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুর বাবা-মাকে প্রথম ভাবনার বিষয় হয়—এই শিশুকে কী খাওয়ানো হবে? বোমার হামলায় মৃত্যুর ভয় তাদের ঘিরে রেখে দেয়।

গাজায় চলমান ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষে অসংখ্য প্রাণহানি হলেও মানবিক সহায়তার প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। ইসরায়েল যখন গাজায় খাদ্যসহ মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছিলেন সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বিষয়ে। আজ সেই দুর্ভিক্ষ বাস্তবে রূপ নিয়েছে, যেখানে খাবারের অভাবে শিশুরা মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন। এছাড়া, গাজার ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলি বাহিনী খাবারকেই এখন মানুষের বিরুদ্ধে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গাজার শিশুরা সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে। তাঁদের শরীর এক্ষেত্রে ‘শুধু চামড়া ও হাড়ের ভর’ বলে এক চিকিৎসক বর্ণনা করেছেন। মানবিক সহায়তার প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখানে খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এবং শত শত শিশু মৃত্যুর মুখে।

খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমদ আল-ফাররা জানিয়েছেন, মাত্র এক সপ্তাহের শিশুখাদ্য মাত্রা রয়েছে তাদের কাছে এবং প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ফর্মুলার মজুদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে নবজাতকদের জন্য সাধারণ শিশুখাদ্যের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে তারা, যা যথেষ্ট নয়। দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হাতে যে শিশুখাদ্য আছে, তা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, এবং হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বাইরেও অনেক শিশু রয়েছে যাদের জন্য কোন দুধই নেই।’’

৫ সন্তানের মা ২৭ বছর বয়সী হানাআ আল-তাওয়িল গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে থাকেন। তিনি জানান, নিজের অপুষ্টির কারণে চিকিৎসা ও খাবারের অভাবের কারণে নিজের সন্তানদের যথাযথ পুষ্টি দিতে পারছেন না। ছোট ছেলের বিকাশ দেরি হচ্ছে এবং অন্যান্য শিশুদের মতো হাঁটতে ও কথা বলতে পারছে না সে। এক করুণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করে হানাআ বলেন, ‘‘রাতে ঘুমের পাশে রুটি রেখে দিই কারণ সে ঘুম থেকে উঠে খাবার চায়। আমি ভয় পাই যে আমার সন্তানরা ক্ষুধায় মারা যাবে।’’

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ ফিলিস্তিনি শিশু অনাহারে মারা গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যা গণহত্যার কৌশল।

অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে তারা শিশুখাদ্য ও মানবিক সহায়তায় বাধা দিচ্ছে না এবং সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ১,৪০০ টনের বেশি শিশুখাদ্য পাঠানো হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত ব্যাগ থেকে আইটেম জব্দ করা হচ্ছে, যা অকালে জন্মানো শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ফর্মুলা ছিল।

গাজার সংকটের প্রকৃত অবস্থা আরও ভয়াবহ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার্ত, এবং মায়েদের অপুষ্টির কারণে তারা শিশুদের পর্যাপ্ত স্তন্যদান করতে পারছেন না। বাজারেও শিশুখাদ্যের দাম খুব বেশি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্রয় করা অত্যন্ত কঠিন।

২৫ বছর বয়সী তিন সন্তানের মা নূরহান বারাকাত জানিয়েছেন, ‘‘আমি মাত্র এক মাসে স্বাভাবিক স্তন্যদান করতে পেরেছিলাম, খাবারের অভাবে আর তা চালিয়ে যেতে পারিনি।’’

গাজার শিশুরা প্রাণ বাঁচাতে এখন মানবতার হাত দাঁড়িয়ে আছে, কারণ তাদের জীবনের জন্য প্রতিটি মুহূর্তই আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই।