দেশের সমৃদ্ধ জলজ জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্যসম্পদের প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে নিষিদ্ধ ‘চায়না দুয়ারী’ জাল। একবার এই জালে মাছ বা জলজ প্রাণী আটকা পড়লে তা সহজে মুক্তি পায় না। মৎস্য অধিদপ্তর এই জাল নিষিদ্ধ করলেও পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা, বি-নগর ও পুঙ্গলী ইউনিয়নে নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে জালের উৎপাদন ও ব্যবসা চেঁড়ে চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকারি নজরদারির মুখে থাকলেও কার্যত প্রশাসনের সামনে ঘরের দরজা বন্ধ করে নৈশপ্রহরী সুরক্ষায় নিরাপদে চলছে চায়না দুয়ারী জালের উৎপাদন। স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়ে এই জালের ব্যাপক চাহিদার কারণে ফ্রেম ও জাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে পাঠানো হচ্ছে।
ডেমরা ইউনিয়নে একাধিক কারখানা মালিক মিলে একটি ‘কারখানা মালিক সমিতি’ গঠন করেছেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুয়েল রানার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই কারখানাগুলো বাধাহীনভাবে চলছে। জুয়েল রানার ‘জুয়েল ফাউন্ডেশন’ নামে অবৈধ সংগঠনের আড়ালে ব্যবসাটি পরিচালিত হচ্ছে যা সরকারি কোনো লাইসেন্সবিহীন।
পুঙ্গলী ইউনিয়নের নারানপুর, রতনপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মানুষ এই অবৈধ জাল উত্পাদনের সাথে যুক্ত। কাজেই ক্রিকেট স্কুলছাত্ররা পর্যন্ত রাতবেলায় জাল তৈরির কাজে যুক্ত হচ্ছে, যা তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বেড়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিলের ব্যবহার বাড়িয়েছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই চায়না দুয়ারী জালে ছোট মাছ এবং মাছের ডিম আটকিয়ে দেশের স্বদেশী মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। জালের ছোট ফাঁস কোনো মাছকে রক্ষা করে না, ফলে পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যখন নিষিদ্ধ জাল ধ্বংস করা হচ্ছে, কেন কারখানা বন্ধ হচ্ছে না?’ ঈদের আগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ একাধিক অভিযান করেও কোনো উন্নতি হয়নি।
ডেমরা ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল রানা দাবি করেন, তার কোনো কারখানা নেই এবং ছোট ভাইয়ের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি একবার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কিছু জাল জব্দ করা হলেও পরে সেগুলো জাল কিনে আনাও হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত সব জাল পুড়িয়ে দেয় না, কিছু বিক্রি হয়। আমি নিজেও জাল কিনেছি, প্রমাণও আছে।’ এছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, কর্মকর্তারা টাকা চেয়ে তাকে চাপ দিতেও চেয়েছে, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ জানান, ডেমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে প্রচুর নিষিদ্ধ জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেগুলো জব্দ করতে যন্ত্রপাতি সরকার থেকে না পাওয়া গেলে সমস্যা হয়। তিনি বলেন, কেউ যদি তার অফিস থেকে টাকা চেয়েছে, তবে তাকে সরাসরি জানাতে হবে। অভিযানের সময় চেয়ারম্যান তার সম্মান রক্ষা করার জন্য তাকে ফোন দেয়নি বরং পেশকারকে ফোন দিয়েছেন।
পাবনায় এই নিষিদ্ধ জালের ব্যবসা এখন শুধু একটি অবৈধ কর্মকাণ্ড নয়, বরং শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রশাসনের অমিলও অভিযোগ উঠেছে। এখন প্রশ্ন থেকে গেছে, সরকার সত্যিকার অর্থেই পদক্ষেপ নেবে কি না, নাকি এভাবেই ইউপি চেয়ারম্যানদের ছত্রছায়ায় অবৈধ ব্যবসার অবস্থা চলতে থাকবে?