ঢাকা | রবিবার | ২০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৫শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

বারবার বন্যায় ভাসছে স্বপ্ন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবিতে ফেনীবাসীর আকুতি

বর্ষামুহুর্ত শুরু হতেই ফেনীবাসীর মনে আবারও জাগে বন্যার আতঙ্ক। এই দুর্যোগ যেন প্রতি বছরে একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবারই বন্যায় জেলার বিভিন্ন এলাকা উচ্চ জলস্তরে প্লাবিত হয় এবং চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয় এসব মানুষ। তারা প্রশ্ন করেন, এত বছর পার হলেও কি টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না? কে দেবে তাদের বন্যার ভয়াবহ থাবা থেকে মুক্তি?

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম শনিবার (১২ জুলাই) ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয়রা তাঁর কাছে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য জোর দাবি জানান। উপদেষ্টা জানান, ফেনীতে শক্তপোক্ত বাঁধ নির্মাণের জন্য ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

ভারতের উজান থেকে নেমে আসা বাঁধভাঙার পানির কারণে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় ব্যাপক বন্যা হয়েছে। পানি ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করে। শুক্রবার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৩টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে, যার ফলে ১১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৩৪,৬০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এই বন্যাকবলিত এলাকায়। সীমান্তবর্তী ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। পলি ও পানি তলায় সড়ক বন্ধ থাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের দুর্দশা দ্বিগুণ হয়েছে।

ধীরে ধীরে পানি নেমে আসলেও ক্ষয়ক্ষতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরশুরামে অর্ধশতাধিক বাড়ি পানিতে ভেঙে পড়েছে। ফুলগাজীতে পানিতে ডুবে রোপা আমন ধান নষ্ট হয়েছে, আবার কেহ কেহর ফসল বালুর স্তূপে ঢেকে গিয়েছে। কৃষকেরা এখন দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।

ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর এলাকার বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম জানান, ‘‘প্রতি বছরই প্রায় একই পরিস্থিতি, বছর ঘেঁটে আবার বন্যায় আমাদের সব ধান, ঘরবাড়ি ভাসছে। এতদিন এখানে থাকার পরও মনে হয়, জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছি।’’

শুধুমাত্র রেজিয়া বেগমই নন, বর্ষার বন্যায় ফেনীর উত্তর অংশের ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লাখো বাসিন্দা বারবার একই সমস্যা মোকাবিলা করে আসছেন। তিন দিনের ভারী বর্ষণ এবং ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির জোরে নদী তীরের বাঁধগুলো ২৩ স্থানে ভেঙে যায়।

ফুলগাজীর শ্রীপুর এলাকার আলী আজ্জম বলেন, ‘‘বাঁধ ভাঙার পর পানি প্রবাহে তীব্রতা বেড়ে যায়, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক আবারও সমস্যায় পড়েছে। রাজনীতি পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য যেন বদলায় না।’’

গাইনবাড়ি এলাকার পুষ্পিতা রাণী বলেন, ‘‘ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাওয়ায় শিশু এবং প্রবীণরা অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। শুকনা খাবার ও নিরাপদ পানির অভাবে অবস্থা আরও খারাপ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা কাজের কারণে বাঁধ ভাঙন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। এখন টেকসই বাঁধ ছাড়া আমরা আর কোনো বিকল্প দেখি না।’’

পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত, ৫০ শতাংশ বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও প্রায় সম্পূর্ণ অচল, ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।

যদিও পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে, দুর্ভাগ্যপ্রাপ্তদের ভিতরে জীবিকা হ্রাস এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা গভীর উদ্বেগের কারণ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রতিদিন দুই বেলা খাবারও ঠিকমতো পাচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে ডায়রিয়া ও কলেরা জাতীয় পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে এবং এতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

ফুলগাজীর এক বন্যাদূর্গত হোসনে আরা (৪০) তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, ‘‘বন্যার সময় আমরা বাড়ির ছাদে ছিলাম, খাবার পানি ছিল না, টয়লেট ডুবে গিয়েছিল, এর ফলে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকে না। রাতে শাড়ি দিয়ে ঘিরে টয়লেট ব্যবহার করতাম। বন্যা আমাদের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।’’

পরশুরামের আবদুল আলি (৫২) বলেন, ‘‘বর্ষা এলেই ভয় পেতে হয়, সামান্য বৃষ্টিতেই বাঁধ ভেঙে পানি এসে গাড়ে। আশা করেছিলাম বেঁচে থাকব, কিন্তু তা হয়নি। এত ভয়ঙ্কর বন্যা আগে দেখিনি।’’

৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় ফেনীর চারটি উপজেলার বিশাল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে তুলেছে প্রায় লাখো মানুষকে। বিস্তৃত অবকাঠামো, ফসল, বাড়িঘর ও অন্যান্য খাতের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্টদের কাছে জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা চাওয়া হচ্ছে।

দুর্গতদের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল, নগদ অর্থ সহায়তা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। মাঝারি পর্যায়ে বাড়ি মেরামত, জল ও পয়োনিষ্কাশনের পুনর্বাসন এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহ একান্ত জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণ পুনর্বাসন ও আয়োজিত কর্মসূচি প্রয়োজন।

বন্যার শুরু থেকে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, ওরস্যালাইন ও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো হচ্ছে। তবে এখন দ্রুত ভাঙা ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, নিরাপদ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরি হয়ে পড়েছে। বন্যার ক্ষতিপূরণে বিশদ পরিকল্পনার পাশাপাশি তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দ্রুত কার্যকর করতে হবে।

প্রতিবারই বন্যার সাথে জীবন যুদ্ধ, ত্রাণের অপেক্ষা, কিছুদিনের টিকে থাকার গল্প। কিন্তু অনেকেই স্থায়ী বাসস্থান ও স্বপ্ন হারিয়ে চলেছেন চিরতরে। এই চিত্র বদলাতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন, যা ফেনীবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি।