দক্ষিণাঞ্চলের নড়াইল জেলা পাট চাষে বিখ্যাত একটি অঞ্চল। খুলনা বিভাগের মধ্যে এ জেলাতেই উন্নতমানের পাট উৎপাদন ঘটে। বোরো ধান কাটার পর কৃষকরা মুখে হাসি নিয়ে পাট চাষ শুরু করেন, আর গত বছরের মতো এবারও ভালো দাম পাওয়ার আশায় তাদের মনে উত্তেজনা বিরাজ করছে। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পাটের আবাদ আরও বেড়েছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু কৃষকদের অভিমত অতিবৃষ্টির কারণে পাটের ফলন ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের সীতারামপুর গ্রামের কৃষক পাগল বিশ্বাস জানান, গত বছর পাটে ভালো দাম পাওয়ায় তিনি বোরো ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ৫০ শতক জমিতে পাট চাষ করেন। চারা গাছ এক হাতের মতো লম্বা হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ অতিবৃষ্টি শুরু হয়। জমিতে জল জমে যাওয়ার কারণে পাটের গাছ বাড়তে পারেনি। অবশেষে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি পাটগাছের চারা কেটে ফেলতে বাধ্য হন, যা তার পরিবারের জন্য ১০-১৫ হাজার টাকার ক্ষতির কারণ হয়।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গত ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে নড়াইলে ২৩,৯০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল। বস্তুনিষ্ঠভাবে ২৩,৪৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয় এবং মোট পাট উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৮২ বেল। চলতি অর্থবছরে(২০২৫-২০২৬) লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ২৩,৯০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের, যেখানে ইতোমধ্যে ২৩,৪৯৮ হেক্টর জমিতে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ৯২৩ বেল।
নড়াইল সদর উপজেলার সলুয়া গ্রামের পাটচাষি বাচ্চু মোল্যার বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট, জুন মাস থেকেই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত চলেছে, যার ফলে জমিতে পানি জমে গেছে এবং অনেক পাটের চারা মারা পড়েছে। বেঁচে থাকা গুলোও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠেনি, যার প্রভাবে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, গত বছর প্রতি মণ পাট বাজারে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল, ভালো মানের পাটের দাম তিন হাজার টাকাও পৌঁছেছিল। গত বছরের মতো এ বছরও যদি পাটের দাম ভালো থাকে, তাহলে কৃষকরা আগামীতে আরও বেশি জমিতে পাট চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করবেন বলে আশা করেন।
লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের সরুশুনা গ্রামের মেহেদী শেখ বলেন, আগে পাট চাষে উৎপাদন খরচও উঠে না, কিন্তু বর্তমানে পাট চাষে ভালোর দিন ফিরেছে। তিনি গত বছরের ভালো পাটের দাম পাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকার যদি প্রতি মণ পাটের দাম তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করেন, তবে পাট চাষের সোনালী দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান, নড়াইলের নলদী, নোয়াগ্রাম ইউনিয়ন ও আশপাশের উঁচু এলাকা থেকে সবচেয়ে ভালো মানের পাট উৎপাদিত হয়।
নলদী বাজারের পাট ব্যবসায়ী মো. শাহিনুজ্জামান জানান, নড়াইলের নলদী ও নোয়াগ্রাম অঞ্চলে উৎপাদিত পাটের মান যথেষ্ট ভালো এবং গত বছর এসব এলাকার পাট সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। ব্রাম্মণডাঙ্গা বাজারের পাট ব্যবসায়ী লাবলু মোল্যা জানান, নড়াইলের পাটের চাহিদা সারাদেশে রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে পাটের দাম ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা হলেও এখনো চলতি বছরের দাম নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তিনি মনে করেন, গত বছরের মতো দাম অব্যাহত থাকলে কৃষকরা আগামিতে আরও বেশি জমিতে পাট চাষে আগ্রহী হবেন।
নড়াইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সৌমিত্র সরকার জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে ২৩,৯০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, যেখানে ২৩,৪৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল এবং ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৮২ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক থাকলেও কিছুটা আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের স্বস্তির কারণ। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বাজার মূল্য বিগত বছরের তুলনায় এবার আরও বেশি হতে পারে। সোনালী আবেগের পাটের সুদিন ফিরে এসেছে এবং বাজার দর আগের মতো থাকলে এ চাষ সহযোগিতায় কৃষকরা বেশি করে পাট চাষে মনোযোগ দেবেন।