ঢাকা | শুক্রবার | ১৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৩শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

মধুপুর শালবনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ

এক সময় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম মধুপুর গড়ের শালবন ছিল একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। এটি ছিল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর, যেখানে অভয়ারণ্যে বিপুল পরিমাণ বন্য প্রাণী, পাখি এবং ভেষজ গুল্মলতা বাস করত। প্রায় ৪৫ হাজার একর বিস্তীর্ণ এই বনে বুনো খাদ্যের বিশাল ভাণ্ডার ছিল, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তবে নানা কারণে বনটির আয়তন সংকুচিত হয়ে গেছে এবং তার প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। কমছে বনের প্রাণিকূল ও বৃক্ষ লতার সংখ্যা, ফলে স্থানীয় বুনো খাদ্যের প্রাচুর্যও কমে এসেছে।

বন সংকোচনের কারণেই সামাজিক বনায়নে বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসী গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বাণিজ্যিক চাষাবাদ বেড়ে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্যও নষ্ট হচ্ছে বলে স্থানীয়রা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সরকার বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির গাছ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি শালবন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দেশি প্রজাতির গাছ যেমন শাল ও গজারির চারাগাছ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বন বিভাগ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও প্রথাগত বনবাসীদের সহযোগিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মধুপুর শালবনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।

মধুপুর বনাঞ্চলে শালবন পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দলের মাঝে গৃহ জরিপ ও জনশুমারির কাজ চলছে। বনের সীমানা চিহ্নিতকরণ, হারিয়ে যাওয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং মতবিনিময় সভার মাধ্যমে বন বিভাগের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হচ্ছে।

২০১০ সালে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির সহযোগিতায় আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদসহ নাগরিক সংগঠনগুলো একটি পিটিশন দায়ের করে বন সংরক্ষণের দাবিতে। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে বন সংরক্ষণের নির্দেশনা জারি করা হয়, যা বাস্তবায়নের জন্য বন বিভাগ ব্রতী।

সাম্প্রতিক সময়ে টাঙ্গাইল বন বিভাগের উদ্যোগে গৃহ জরিপের জন্য প্রশিক্ষণ নেয়া হয়েছে ২০ জন জরিপসহকারীকে। ৯ জুলাই ‘মধুপুর শালবন পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ প্রকল্পের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় বন কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বন বিভাগ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বন সীমানা চিহ্নিতকরণ, হারিয়ে যাওয়া বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও গৃহ জরিপসহ নানা কার্যক্রম চলছে। শালবন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মধুপুরের লাল মাটির শালবন তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে পাবে এবং দেশি পরিবেশ-সন্মত গাছবাড়িতে পরিণত হবে।

প্রকল্পের আওতায় অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে জনসংখ্যা, জমির পরিমাণ, কৃষি ফসল, লিজকৃত জমির তথ্য এবং শালবনে লাগানোর জন্য সঠিক গাছের পছন্দ ইত্যাদি। জরিপের শেষে শাল ও গজারিসহ দেশি গাছ লাগিয়ে বন পুনর্গঠন করা হবে। অংশীদাররা গাছের সংখ্যা ও মূল্য গণনা করে লাভের অংশ পাবেন, তবে বনীয় গাছ কাটা হবে না।

ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন আরও বলেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। মধুপুর শালবনের ঐতিহ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে বন বিভাগের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করেন সংশ্লিষ্টরা।