ঢাকা | সোমবার | ২৮শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা সফর, ১৪৪৭ হিজরি

তিন প্রধান সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য হয়নি জাতীয় ঐক্য কমিশনে

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং নারীদের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসনে ভোট প্রদানের পদ্ধতি—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য কমিশন এখনও একযোগে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।

বিএনপি ও জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় প্রায় মিল রয়েছে; তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ কিছু দলের ভিন্ন মত থাকায় এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সমঝোতায় আসা যায়নি।

জাতীয় ঐক্য কমিশন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৯টি মূল সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে একটি জাতীয় সনদ (রিফর্ম চার্টার) তৈরি করতে চায়, কিন্তু দ্বিতীয় দফার সংলাপ ধীরগতিতে এগোচ্ছে যেখানে তিনটি এই ইস্যুর ওপর দলগুলোর মতপার্থক্য প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে।

এই পরিস্থিতি কাটাতে কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং সংসদের উচ্চকক্ষের কাঠামো নিয়ে একাধিক সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারনায় নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াত তাদের প্রস্তাবে ভিন্নতা থাকলেও সম্প্রতি তারা কিছুটা মিল রেখে সংশোধিত প্রস্তাব তুলে ধরেছে।

সংশোধিত এক প্রস্তাবে চার সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলীয়)। এই কমিটি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল থেকে পাঁচজন করে প্রার্থী বাছাই করবেন। মতৈক্য না হলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তবে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার ধারাটি বাদ দেয়া হবে।

জামায়াত তাদের প্রস্তাবে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কথা বলেছে, যেখানে জাতীয় সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন সদস্যও থাকবেন। তারা প্রস্তাব দিয়েছে, ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দল থেকে তিনজন করে, তৃতীয় বৃহত্তম দল থেকে দুইজন এবং অন্যান্য দল বা স্বতন্ত্র সদস্য থেকে একজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে। মতৈক্য না হলে রাষ্ট্রপতির বিকল্প ব্যবস্থা বাদ দিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।

বাঁ পক্ষই মনে করে, অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের সম্মতিক্রমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের নির্বাচন হওয়া উচিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কমিশনের প্রস্তাবের প্রতি নমনীয়তা দেখিয়ে বলেছেন, সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধি থাকলে সমস্যা হবে না।

তবে এনসিপি সহ কিছু দল রাষ্ট্রপতির বিকল্প ব্যবস্থা সংরক্ষণের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে এবং ‘র‍্যাংকড চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্বাচন করার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তুলেছে।

জাতীয় ঐক্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে প্রার্থীদের নাম উপস্থাপন করা হবে। সম্মতিতে না আসলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল তিনজন করে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল দুইজন করে প্রার্থী মনোনয়ন করবে। এরপর র‍্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হবে।

এদিকে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং সংরক্ষিত নারী আসন বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ অধিকাংশ দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের পক্ষে। তারা উচ্চকক্ষে ১০০টি এবং নিম্নকক্ষে ৪০০টি আসনের প্রস্তাব দিয়েছে। সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে বৃদ্ধি করে ১০০ করার ব্যাপারেও প্রায় সকলেই একমত।

তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। জামায়াত চায় উচ্চকক্ষ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনে ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি প্রয়োগ হোক, অন্যদিকে বিএনপি প্রস্তাব করেছে নিম্নকক্ষ সদস্যসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এই নির্বাচন হোক।

বর্তমানে জাতীয় ঐক্য কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ পদ্ধতি ও সাংবিধানিক সংস্কার ইস্যুতে আলোচনা ও সমঝোতায় এনে অচলাবস্থা কাটিয়ে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।