নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ, জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন ও নারীদের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন পদ্ধতি— এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভেতরে এখনো গভীর মতানৈক্য বিরাজ করছে।
বিএনপি ও জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায় অভিন্ন প্রস্তাব দিলেও, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ কয়েকটি দলের ভিন্নমতের কারণে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৯টি সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে চাইলেও, দ্বিতীয় দফার আলোচনা ধীরগতির কারণ মূলত এই মতপার্থক্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াত একাধিক পরামর্শ দিয়েছে। গত সোমবার কমিশনে ভাগ করা সংশোধিত প্রস্তাবে চার সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব ছিল, যার সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। এই কমিটি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের ১০ সদস্যের মধ্য থেকে আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বেছে নেবে। মতৈক্য না হলে ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তবে রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্ব দেওয়ার ধারাটি বাদ দেওয়া হবে।
জামায়াতের প্রস্তাবে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি রয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধিও থাকবেন। তারা প্রস্তাব করেছে প্রধান বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন পক্ষ থেকে তিনজন করে, তৃতীয় বৃহত্তম দল থেকে দুইজন এবং অন্যান্য দল বা নিজস্ব প্রার্থীদের একজন করে মনোনয়ন দেবেন। মতৈক্য না হওয়া অবস্থা ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে যে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেটি বাতিল থাকবে।
বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই মনে করে, অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের সম্মতিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বাছাই করা উচিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি থাকলে তাদের জন্য সমস্যা নেই। তবে এনসিপি ও কয়েকটি দল ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির বিকল্প প্রক্রিয়ায় আপত্তি জানিয়েছে। তাদের পক্ষে রয়েছে ‘র্যাংকড চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা সম্ভব।
জাতীয় ঐক্য কমিশনের প্রস্তাবেও জামায়াতের কাঠামোর সানুযায়ী অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। প্রত্যেক দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে একজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। সম্মতিতে পৌঁছানো না গেলে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দল তিনজন করে, এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল দুইজন প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। এরপর অনেক স্তরের নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচন করা হবে।
বিভিন্ন দল ভোটিং পদ্ধতি এবং অনুসন্ধান কমিটির কার্যক্রম নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করায় আলোচনা আগামীতে আরো জটিল হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
একই সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের ব্যাপারে একাধিক দল সমর্থন জানিয়েছে, যেখানে উচ্চকক্ষে ১০০টি ও নিম্নকক্ষে ৪০০টি আসন থাকা হবে। সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবও বেশিাংশ দলের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য এখনও অটুট রয়েছে। জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ ও সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের পক্ষে, যেখানে বিএনপি চায় নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ভোট গ্রহণ হোক।
এই সংকট এবং মতপার্থক্যের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ আগামী দিনের রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয় হয়ে থাকবে।