তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে, যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, তখনও শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সারিকালীনগর গ্রামের নামাপাড়া এলাকায় কিছু মানুষ আছেন বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারে জীবন কাটাচ্ছেন। ওই গ্রামের ৯৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ আবুল কাশেম এবং তার সন্তানের তিনটি পরিবার আজও কুপি বাতি ও হারিকেনের আলোর উপর নির্ভর করে দিন যাপন করছেন। ২০২৫ সালের এই বাস্তবতা যেন অবিশ্বাস্য এক দুঃখকর গল্প।
এই তিনটি পরিবার বছরের পর বছর কোনো বিদ্যুত সুবিধা ছাড়াই জীবনের প্রতিদিন কেটেছে। তাদের ঘরে নেই বৈদ্যুতিক বাল্ব, নেই সৌর প্যানেল, এমনকি চলাচলের উপযোগী রাস্তা পর্যন্ত নেই। বর্ষা মৌসুমে ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়, আর জলাবদ্ধতার মধ্যে কাটে সাধারণ দিনের পর দিন। বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
বৃদ্ধ আবুল কাশেম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৯৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকে এখানেই বসবাস করছি। তবুও নিজের ঘরে বিদ্যুতের আলো একবারও দেখিনি। শুধু হারিকেনের আলোতেই চলতে হয়। রাস্তা না থাকায় অন্যের জমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। আমার বড় ছেলে মারা গেছে, কিন্তু ঠিকমতো জায়গা না থাকার কারণে ঘরের মেঝেতেই তাকে দাফন করেছি। মানুষ ছবি তুলে যায়, কিন্তু আর কেউ খোঁজ নেয় না।’
জমির তীব্র সংকটের কারণে এই পরিবারে মৃত্যুর পর মরদেহ দাফনের জন্যও কোনো স্মরণীয় জায়গা অবশিষ্ট নেই। কাশেমের বড় ছেলের মৃত্যুর পর ভাঙা ঘরের মেঝে ফেলে তাকে কবর দিতে হয়েছিল। এখন আর দাফনের উপযোগী স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনে যেমন আলো নেই, মৃত্যুতেও নেই নিশ্চিত ঘরের মধ্যেই কবর।
এই পরিবারে কেউই শিক্ষার আনন্দ পাইনি। ছোট-বড় সবাই জীবন কাটিয়েছে কুপি বাতির আলোয়। রান্না, সেলাই এবং গৃহস্থালির প্রতিটি কাজই চলে কেরোসিন জ্বালানো হারিকেনের আলোর সাহায্যে। রাতে নিয়ম করে হারিকেন পরিষ্কার, কেরোসিন ভরা এবং রেশা বদলানো তাদের দিনে-রাতে চলার নিয়ম। এই জীবন যেন কুড়িয়ে আনা গ্রামীণ অতীতের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল এই বিষয়ে বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে এবং দ্রুত খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই পরিবারগুলো যেন বিদ্যুৎ, রাস্তা ও পানির সুষ্ঠু সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছে।’
দ্বারা সেচ্ছাসেবী ও তরুণ সমাজও এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ‘ব্লাডচাই’ প্রতিষ্ঠাতা শান্ত শিফাত বলেন, ‘আমরা যখন উন্নয়নের গল্প করি, তখন এমন একটা পরিবার বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে বসবাস করছে এই অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত সেখানে বিদ্যুৎ এবং মৌলিক সেবাগুলো পৌঁছে দিতে হবে।’
স্বেচ্ছাসেবী মঞ্জুরুল ইসলাম যোগ করেন, ‘ওই পরিবার কেবল আলো থেকে নয়, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত রয়েছে। এটা কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটা সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে।’
স্থানীয় তরুণ শুভ বলেন, ‘শৈশব থেকে আমি ওই বাড়িতে কুপি বাতির আলো দেখি। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগের সামর্থ্য নেই। আমরা চাই, এই অবহেলা যেন অবিলম্বে বন্ধ হয়।’
এক সময় গ্রামীণ জীবনের পরিচিত ছবি ছিল কুপি বাতি ও হারিকেন। তবে আজও নামাপাড়ার এই পরিবারগুলো সেই পুরনো আলো আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। উন্নয়নের ঢেউ বয়ে চললেও ঝিনাইগাতীর এই নিভৃত মানুষের জীবনে অন্ধকার যেন এক নির্মম বাস্তবতা রয়ে গেছে।