ঢাকা | বৃহস্পতিবার | ৩১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৬ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

গাইবান্ধায় বিদ্যুত্চালিত কাঠের ঢেঁকিতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টି

একসময় গ্রামবাংলার উঠোনগুলোতে ধান ভানার ঢেঁকির কটকটে শব্দ ছিল অতি পরিচিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই প্রচলিত পদ্ধতি। তবুও গাইবান্ধার এক উদ্যমী যুবক শফিকুল ইসলাম নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন সেই পুরনো ঐতিহ্যকে। তিনি তৈরি করেছেন বিদ্যুত্চালিত কাঠের ঢেঁকি, যার মাধ্যমে উৎপন্ন হচ্ছে পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত লাল চাল। বর্তমানে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই লাল চাল পৌঁছে দিচ্ছেন এবং তার স্বপ্ন, ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারেও এই চাল রপ্তানি করা যাবে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের খামার বোয়ালী গ্রামের এই যুবক পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চার বছর চাকরি করেও উদ্যোক্তা হওয়ার তাগিদে ২০২০ সালে চাকরি ছেড়ে বৈদ্যুতিক কাঠের ঢেঁকি আবিষ্কার করেন।

নিজ বাড়ির উঠোনে তিনি স্থাপন করেছেন রেল আকৃতির একটি ঘরে দুটি ইলেকট্রিক ঢেঁকি। ঢেঁকির শব্দে চলছে ধান ভানা, উৎপাদিত হচ্ছে আঁশযুক্ত লাল চাল। স্থানীয় চারজন নারী শ্রমিক নানা ধাপে ধান দেওয়া, চাল ঝাড়াই ও বাছাইয়ের কাজ করছেন। পাশের অফিস ঘরে এক ম্যানেজার অনলাইনে অর্ডার সংগ্রহ করছেন।

শফিকুল জানান, একটি জোড়া ঢেঁকি প্রতিদিন প্রায় ১৫০ কেজি চাল উৎপাদন করতে পারে, যা মাসে প্রায় ১০০ মণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। বর্তমানে তার কারখানায় পাঁচজন স্থায়ী ও সাতজন মৌসুমি শ্রমিক কাজ করছেন। আগামী পরিকল্পনা রয়েছে আরও পাঁচটি ঢেঁকি স্থাপন করার, যার ফলে দৈনিক উৎপাদন ৫০০ কেজিতে উন্নীত হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে ১৫ থেকে ২০ জনে।

তিনি বলেন, “আমার উৎপাদিত ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল সম্পূর্ণ কেমিক্যাল মুক্ত। প্রচলিত রাইস মিলের চালের তুলনায় আমার চাল অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর, কারণ এতে ফাইবার অক্ষুণ্ণ থাকে। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত কিংবা স্বাস্থ্য সচেতন, তাদের কাছে এই চালের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।”

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়মিত অর্ডার আসছে। এমনকি ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও রপ্তানির আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তবে ট্রেড লাইসেন্স ও এক্সপোর্ট পারমিশনের অভাবে এখনো বিদেশে চাল পাঠানো সম্ভব হয় নি।

শফিকুল জানান, তিনি প্রধানত গানজিয়া ধান প্রজাতি ব্যবহার করেন, যার লাল চাল প্রতি মণ ৪০০০ থেকে ৪৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। গানজিয়া ধানের এই লাল চালের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এটি মূলত দুই শ্রেণির মানুষ ক্রয় করছেন—এক তারা যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, এবং দ্বিতীয় যারা নিজেদের সুস্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন।

তিনি আরও বলেন, দেশের সর্বত্র সহজলভ্যে এই চাল পৌঁছে দিতে হলে প্রত্যেক জেলায় বিপণন কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি সহায়তার দাবি জানান তিনি। তার মতে, যথেষ্ট প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা রয়েছে এবং প্রয়োজন হলে মাত্র ২৫ জোড়া, অর্থাৎ ৫০টি ঢেঁকি স্থাপন করেও দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এতে অন্তত দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং দারিদ্র্য দূর হতে সাহায্য করবে, পাশাপাশি জাতীয় আয়ও বাড়বে।

শফিকুল আরও দাবি করেন, দেশে তিনিই প্রথম ইলেকট্রিক কাঠের ঢেঁকি আবিষ্কার করেছেন এবং এটি তার নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্যাটেন্ট। সরকারি স্বীকৃতি ও পেটেন্ট না পেলে অন্য কেউ হয়তো এটিকে নিজেদের নামে নিবন্ধন করে নিতে পারে। তাই দ্রুত প্যাটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের স্বীকৃতি জরুরি।

ম্যানেজার আখতার হোসেন বলেন, “অনলাইনে প্রচুর অর্ডার আসছে। দাম কিছুটা বেশি হলেও খরচ বিবেচনায় এটি খুবই ন্যায্য। প্রত্যেক জেলায় আউটলেট থাকলে দাম অনেকটাই কমানো সম্ভব।”

গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফেরদৌস উল্লেখ করেন, “শুরুর দিক থেকে শফিকুলকে ঋণসহ সব ধরনের সহায়তা প্রদান করেছি। তার শিল্প এখন অনেক এগিয়েছে। পূর্ণ সমর্থন পেলে হাজারো বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”

গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শারমিন আখতার বলেন, “উদ্যোক্তার সৃষ্টি মানেই কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। জেলা প্রশাসন শফিকুলের এই শিল্পকে সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।”