গাজা উপত্যকা, মধ্যপ্রাচ্যের এমন এক অঞ্চল যেখানে জন্ম হয় যেন আজন্ম একটি দুর্ভাগ্যের নতুন অধ্যায়। সাধারণত শিশুর আগমন পরিবারে আনন্দ এবং নতুন আশা নিয়ে আসে। কিন্তু গাজার শিশু জন্মলগ্ন থেকেই পরিবারের কাছে হয়ে ওঠে অতর্কিত চিন্তার কারণ—এই শিশু কি নিরাপদ থাকবে? কী খাবে? কখন বোমার গুঁড়োকণা তার প্রাণ ছিনিয়ে নেবে—এই দুশ্চিন্তায় বর্তমান গাজার প্রতিটি মা-বাবা দিন-রাত কষ্টে কাঁদছেন।
গাজার দীর্ঘ প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের কারণে জীবন ধ্বংস হয়েছে, যা বিশ্বকে প্রতিনিয়ত চিন্তায় ফেলে দেয়। তবে নতুন রণনীতির আওতায় ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা ও খাবার সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, এর ফলে এখানে দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি হবে। আজ সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী খাদ্যকেই মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন, মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে খাবারকে এক ধরনের যুদ্ধকৌশলে রূপ দিয়েছেন।
সবচেয়ে করুণ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ ও দুর্বল অবস্থায় পড়েছে গাজার শিশুরা। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমদ আল-ফাররা ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে জানান, ‘গাজার শিশুদের অবস্থা এমন, যেন শুধু চামড়া ও হাড়ের খসড়া হয়ে গেছে।’ বর্তমানেও খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতিতে শত শত শিশু মৃত্যুর মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ডা. আহমদ আরও জানান, তার ওয়ার্ডে মাত্র এক সপ্তাহের জন্যই শিশুখাদ্যের মজুদ আছে, বিশেষ করে প্রি-ম্যাচিউর অর্থাৎ সময়ের আগেই জন্ম হওয়া শিশুদের জন্য বিশেষ ফর্মুলার ঘাটতি প্রকট। বাধ্য হয়ে নবজাতকদের জন্য সাধারণ শিশুখাদ্যের ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে অসমর্থ।
ইসরায়েলের পক্ষ গাজার মধ্যে শিশু খাদ্য সরবরাহে বাধা না দেয়ার দাবি করলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের ব্যাগ থেকে শিশুখাদ্যের কৌটা জব্দের ঘটনা ঘটেছে। ফিলিস্তিনি-জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. ডায়ানা নাজ্জাল বলেন, ‘এই বিশেষ শিশুখাদ্য কৌটা জব্দ করার মাধ্যমে ইসরায়েল শিশুদের জীবনের সঙ্গে নির্মম খেলাচ্ছে।’
গাজার অনেক মা-স্বাস্থ্য কর্মী নিজে অপুষ্টিতে ভোগার কারণে সন্তানকে স্তন্যদান করতে পারছেন না, ফলে শিশুখাদ্যের চাহিদা আরও বেড়েছে। বাজারে সামান্য যা আছে তার দাম পৌছে গেছে আকাশছোঁয়া, যেখানে এক কৌটা ফর্মুলার দাম প্রায় ৫০ ডলার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বেশি।
নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে থাকেন হানাআ আল-তাওয়িল নামের এক ২৭ বছর বয়সী মা, যিনি জানান নিজেও পর্যাপ্ত খাবার পান না, তাই বুকের দুধও কম হচ্ছে। তার ১৩ মাস বয়সী সন্তান এখন সঠিক পুষ্টি না পাওয়ায় বিকাশে পিছিয়ে পড়েছে, হাঁটতে ও কথা বলতে পারছে না। তার আক্ষেপ, ‘যখন সে ঘুমায় আমি পাশে একটি ছোট টুকরো রুটি রেখে দিই, কারণ রাতে খাবারের জন্য কান্নাকাটি করে।’
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৬ ফিলিস্তিনি শিশু অনাহারে মারা গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল বেসামরিক ফিলিস্তিনি জনগণের উপর ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যা গণহত্যার সমতুল্য।
বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে গাজার শিশুদের জন্য দ্রুত এবং পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বজুড়ে মানবিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি গাজার মানবিক সংকটের কষ্টকর বাস্তবতা বোঝা ও সমাধানে নিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।