ঢাকা | রবিবার | ২০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৫শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

পাবনায় নিষিদ্ধ চায়না জাল উৎপাদন বন্ধ না হওয়ায় চলছে অবৈধ সিন্ডিকেট

দেশের জলজ জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষিদ্ধ ‘চায়না দুয়ারী’ জাল। এ ধরনের জালে মাছ বা জলজ প্রাণী once আটকা পড়লে তা থেকে মুক্তি পাওয়া near অসম্ভব। মৎস্য অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরেই এই জাল নিষিদ্ধ করলেও, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা, বি-নগর ও পুঙ্গলী ইউনিয়নে এর অবৈধ উৎপাদন ও व्यापार ক্রমেই বাড়ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রশাসনের চোখের সামনে গোপন নয়, নিরাপদ ঘরের গোপনে গেট বন্ধ করে নির্বিঘ্নে চলছে চায়না জালের উৎপাদন। এই জালের ব্যাপক চাহিদা থাকায় স্থানীয় কারখানাগুলো নিজেরাই তৈরি পোড়ামাটির ফ্রেম এবং নকশা অনুযায়ী তৈরি করা জাল দেশের বিভিন্ন স্থানে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে।

ডেমরা ইউনিয়নে একাধিক কারখানা মালিক মিলে গঠন করেছেন ‘কারখানা মালিক সমিতি’। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই সমিতিকে পৃষ্ঠপোষণ করছেন ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুয়েল রানা। তাঁরা জানান, চেয়ারম্যানের সরাসরি সহযোগিতায় কারখানাগুলো নিশ্চিন্তে চলছে। এই মালিকদের মধ্যে রয়েছেন নিত্য হাওলাদার, দীপ্ত হাওলাদার, শ্যামল, বিপ্লব, সুশান্ত হাওলাদার, পশু চিকিৎসক পরিতোষ হাওলাদার ও মাজাট সুইচগেট এলাকার আল-আমিন।

পুঙ্গলী ইউনিয়নের নারানপুর পশ্চিমপাড়া, কিবরুল, রতনপুর উত্তরপাড়া এলাকার কালাম, রুহুল আমিন, মালেক, খোয়ালিদ, শাহিন ও মোমিনসহ বহু স্থানীয় ব্যক্তি এই অবৈধ জাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছ, চেয়ারম্যান নিজেও ‘জুয়েল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি অবৈধ সংগঠনের আড়ালে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। সংগঠনের কোনো অফিস বা সরকারি রেজিস্ট্রেশন নেই। মাঝে মাঝে চাল বিতরণ করলেও সেটা সরকারি নয়, নিজের টাকায় দেওয়া বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, ‘জুয়েল ফাউন্ডেশন’র বৈধ কোনো লাইসেন্স নেই।

কারখানায় অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর চাকরি হচ্ছে, যাঁরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে জাল তৈরির কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এতে তাদের পড়াশোনায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, পাশাপাশি সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক ও নানা সমস্যা বাড়ছে।

অন্যদিকে, রাতের বেলায় জাল তৈরির সুযোগ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সক্রিয়, বিশেষ করে রতনপুরসহ আশপাশের এলাকায় ইয়াবা, গাঁজা ও ফেন্সিডিলের ব্যবহার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চায়না দুয়ারী জালের কারণে মাছের ডিম ও ছোট মাছ ধরা পড়ায় দেশীয় মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির প্রাতে রয়েছে। প্রায় ৫০ থেকে ১০০ ফুট দীর্ঘ এবং দেড় ফুট চওড়া এই জালের ফাঁস এতই ক্ষুদ্র যে কোনো মাছ জীবিত রক্ষা পায় না।

স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জাল ধ্বংস করা হলেও কেন কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে না?’ ঈদের আগেও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ একাধিক অভিযান চালিয়েছেন, কিন্তু দৃশ্যত কোনো সুফল মিলছে না।

ডেমরা ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল রানা জানান, তাঁর কোনও কারখানা নেই। তাঁর ছোট ভাই পূর্বে ব্যবসা করতেন, পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন, একবার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কিছু জাল বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, পরবর্তীতে সহকারী কমিশনারের লোকজন থেকে টাকা দিয়ে জাল কিনে এনেছেন। তিনি আরও দাবি করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সব জাল পুড়িয়ে ফেলা হয় না, কিছু পুড়িয়ে বাকিটা বিক্রি করে দেওয়া হয়। নিজে এমন জাল কিনেছেন এবং তার প্রমাণও রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরাও চাই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হোক। কিন্তু অভিযান চালিয়ে টাকা খেয়ে আবার কারখানা চালানোর সুযোগ দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। ঈদের আগে আমাকে টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল অফিস থেকে, কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছি।’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানাউল মোর্শেদ বলেন, ‘সম্প্রতি ডেমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ জাল ধ্বংস করা হয়েছে। সেদিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না, থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা যেত। যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা গেলে সমস্যা কম হত, কিন্তু পরিবহনের জন্য সরকারি বরাদ্দ না থাকার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ‘আমার অফিস থেকে কেউ টাকা চেয়ে থাকলে সরাসরি আমাকে জানাতে হবে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি কারো সম্মান রক্ষা করতে।’ অভিযানের সময় ইউপি চেয়ারম্যান ফোন দিয়ে পেশকারকে পরিচালনা বন্ধ করতে বলেছেন যাতে তাঁর সম্মান রক্ষা পায়। আমরা মামলা করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাউকে ছবি তুলতে দিইনি এবং নির্বিঘ্নে অভিযান শেষ করেছি।

পাবনায় নিষিদ্ধ চায়না জালের অবৈধ উৎপাদন এখন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে, যেখানে কিছু অসাধু প্রশাসনিক সদস্যের যোগসাজশ অভিযোগ পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। এখন প্রশ্ন, সরকারি কর্তৃপক্ষ কি সত্যিকার অর্থেই কঠোর পদক্ষেপ নেবে, নাকি শুধুই দৃষ্টিপথের আড়ালে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে এই অবৈধ ব্যবসা চলতে থাকবে?