ঢাকা | শনিবার | ২রা আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৮ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

শুল্ক হ্রাসে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন

বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে পাল্টা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ

করাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন

বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হলেও এখনই একটি

কার্যকর, বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান

ধরে রাখতে এবং স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও

সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

বর্তমানে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ

অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা রুবেল বলেন,

‘পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক

দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনাও

রয়েছে।’

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এই চুক্তিকে একটি ‘সুস্পষ্ট

কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘আজকের সাফল্য প্রমাণ করে বাংলাদেশ কতটা

প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও অগ্রগতিতে

অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা দেখিয়েছে।’

তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে আলোচকরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন এবং শুল্ক, অশুল্ক ও

জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক জটিল আলোচনার মধ্য দিয়ে সফলভাবে পথ অতিক্রম করেছেন।

প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, এই

চুক্তির মাধ্যমে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকল। সেই সঙ্গে বিশ্বের

সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশাধিকার আরও বাড়ল এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থও সুরক্ষিত

হলো।

এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থানকেই শক্তিশালী করেনি বরং আরও বেশি

সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও স্থায়ী সমৃদ্ধির পথ

তৈরি করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি

বাণিজ্যিক গতিশীলতায় এটিকে ‘দারুণ অগ্রগতি’ হিসেবে উল্লেখ করে মহিউদ্দিন রুবেল

বলেন, বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সামঞ্জস্য

রেখে পারস্পরিক শুল্কহার ২০ শতাংশে নির্ধারণ করেছে, যা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে দেশের

অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।

তিনি বলেন, ভারতের ২৫ শতাংশ ও চীনের তুলনামূলক উচ্চ শুল্কহারের প্রেক্ষিতে

বাংলাদেশের এই অবস্থান বাণিজ্য পরিবেশ অনুকূল করে তুলতে পারে এবং চীনের কিছু বাজারও

বাংলাদেশে সরতে পারে।

রুবেল আরও বলেন, খুচরা দামে সম্ভাব্য বাড়তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্পমেয়াদে

বিক্রয়ে কিছু প্রভাব পড়তে পারে, তবে অতীতের দৃঢ়তা ও সহনশীলতা ইঙ্গিত দেয় যে,

বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে সফলতার জন্য ভালোভাবেই প্রস্তুত।

খুচরা সাময়িক বাড়তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিতে স্বল্পমেয়াদে কিছু প্রভাব পড়লেও,

অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের জন্য ভালোভাবে

প্রস্তুত।

তিনি বলেন, কোভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যে দৃঢ়তা ও অটলতা

দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।

‘যদিও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে স্বল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা

ওঠানামা করতে পারে, বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ও অতীত দক্ষতা ভবিষ্যতে স্থায়ী

অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়,’ বলেন রুবেল।

একটি সুযোগ, একটি সতর্কবার্তা

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম

রায়হান বলেন, ‘এটি যেমন একটি সুযোগ, তেমনি একটি সতর্কতাও। বাংলাদেশকে এখনই একটি

বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক এবং সহনশীল বাণিজ্য কৌশল গড়ে তুলতে হবে।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কহার ৩৫

শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করাকে দেশের রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও

উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

তিনি বলেন, ‘এই হ্রাস মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পাল্টা শুল্ক কাঠামোর

পুনর্বিন্যাসের অংশ, যা তাদের অনেক বাণিজ্য অংশীদার দেশেই প্রযোজ্য হচ্ছে।’

উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, শ্রীলঙ্কার ওপর শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০

শতাংশ এবং পাকিস্তানের ২৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৯ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে

বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ ও ভারতের শুল্ক হার ২৫

শতাংশে রয়েছে।

পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সুস্পষ্ট কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান

উপদেষ্টা

এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের নতুন শুল্কহার এখন প্রতিযোগী

দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক সামান্তরালে এসেছে, যা রপ্তানি বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে

বাণিজ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনবে এবং বড় ধরনের অস্থিরতার সম্ভাবনাও হ্রাস করবে।

তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে—চীনের

ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

বিশ্ব উৎপাদনে চীনের প্রধান ভূমিকা এবং বেশ কিছু রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে

চীনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে, চীনের ওপর শুল্ক নির্ধারণ

সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহ গঠনে

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘যদি চীনের ওপর উল্লেখযোগ্য হারে শুল্ক আরোপ করা হয়,

তাহলে—বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চাহিদা স্থানান্তরের

সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিপরীতে, চীনের জন্য অনুকূল হার নির্ধারিত হলে প্রতিযোগিতা

আরও তীব্র হতে পারে।’

তাই, আগামী দিনে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্য কোন দিকে ঝুঁকবে—তা নির্ধারণে চীনের

জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত শুল্ক শর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন

তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলগত বিজয়

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে পাল্টা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার

সিদ্ধান্তকে অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক কৌশলের ‘একটি বড় কৌশলগত বিজয়’ বলে

মন্তব্য করেছেন ঢাকায় কর্মরত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিজ।

তিনি বলেন, ‘হোয়াইট হাউসের ঘোষণায় স্পষ্ট যে, এই আলোচনার কৃতিত্ব অন্তর্বর্তী

সরকারের নীতিগত অবস্থান ও কৌশলগত সক্ষমতারই প্রতিফলন।’

তিনি আরও বলেন, চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সামনে আসার বাকি থাকলেও এটি উভয় দেশের

জন্যই একটি ইতিবাচক অর্জন।

পড়ুন: আরও ৬৯ দেশের ওপর নতুন হারে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ

গত চার মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকার এবং প্রধান আলোচক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড.

খলিলুর রহমান নানা দিক থেকে প্রবল চাপের মুখে থেকেও ধারাবাহিক অগ্রগতি ধরে রেখেছেন

বলেও মন্তব্য করেন ড্যানিলোভিজ।

‘আলোচনার ফলাফল ইতিবাচক হওয়ায় এখন সমালোচকদের নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার

সময় এসেছে,’ বলেন ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা এই সাবেক কূটনীতিক।

তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই সনদে অগ্রগতি, জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা এবং

যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বিষয়ে ইতিবাচক খবর—সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো

সপ্তাহ।’

এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্য

স্থিতিশীলতা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় বাণিজ্য

উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন প্রমাণ করেছেন, তিনি দায়িত্ব পালনে দৃঢ় এবং কার্যকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, এই অর্জনের পর তাদের হতাশই

হতে হবে।’

আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি

বাংলাদেশের প্রধান আলোচক ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খালিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা

দায়িত্বশীলভাবে আলোচনা করেছি যাতে আমাদের অঙ্গীকারগুলো জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার

সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।’

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের খাদ্য

নিরাপত্তা অর্জনে সহায়তা করবে এবং মার্কিন কৃষিভিত্তিক রাজ্যগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক

তৈরি করবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানই ধরে রাখিনি, বরং বিশ্বের

সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগও তৈরি করেছি।’

তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে সরকার

বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার কার্যাদেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে

গম ও সয়াবিন আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত ২৭ জুলাই বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

বোয়িংয়ের ২৫টি বিমান কেনার আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং পাশাপাশি গম ও সয়াবিন আমদানিও

বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী কয়েক বছরে বিমানের প্রয়োজন মেটাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া

হয়েছে। ভারতের অর্ডার ১০০, ভিয়েতনামেরও ১০০ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৫০। আমরা

তুলনামূলকভাবে কম কিনলেও, আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথেষ্ট।’

পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যে শুল্ক কমানো ‘সন্তোষজনক’: আমীর খসরু

এ দিকে বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন

শুল্ক কার্যকর করার কথা জানালেও তা সাত দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এপির মতে, যদিও এই পরিবর্তন এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি না করা

দেশগুলোর জন্য সম্ভাব্য শুভ সংবাদ হলেও, এতে কখন-কি ঘটবে তা নিয়ে ভোক্তা ও

ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন এক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।